ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। সরকার গঠিত ১১টি তদন্ত দলের অনুসন্ধানে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি অন্তত ১০টি প্রভাবশালী শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি এবং অর্থ পাচারের মতো গুরুতর অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে।
বিশেষ করে সামিট, এস আলম, বেক্সিমকো, নাসা, সিকদার, জেমকন, ওরিয়ন, আরামিটসহ বেশ কয়েকটি গ্রুপ সরকারপ্রধানের ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে তা বিদেশে পাচার করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব পাচারের তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও অন্যান্য যৌথ তদন্ত সংস্থাগুলো।
অর্থ আত্মসাৎ, ঘুষ গ্রহণ ও রাজস্ব ফাঁকির মাধ্যমে উপার্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে জানানো হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে ইতোমধ্যে কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তির প্রস্তুতি নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এসব দেশ থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শতকোটি টাকা দেশে ফেরত আসতে পারে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
তথ্য বলছে, পাচারকৃত অর্থের সঙ্গে সামিট, এস আলম, সিকদার, আরামিট, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), টাস্কফোর্সসহ তদন্তসংশ্লিষ্ট ৯টি সংস্থা। এসব শিল্প-বাণিজ্য গ্রুপের কয়েকজন কর্ণধার গোপনে বিদেশি নাগরিকত্বও নিয়েছেন। আর এসব গ্রুপ সবচেয়ে বেশি পাচার করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, হংকং, স্লোভাকিয়া, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পাচার হওয়া সেই অর্থ ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে সুইজারল্যান্ডসহ ৯টি দেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পর্যায়ক্রমে চিঠি দিয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি দেশ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র বলছে, পাচার হওয়া দেশগুলোর মধ্যে ৮টি দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) করা হয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি সংস্থা বাংলাদেশের পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেসব প্রতিষ্ঠানের পাচারের প্রমাণ পাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বাংলাদেশি আইনে বিচার করবে। এরপর ওই বিচারের রায়ের কপি সংশ্লিষ্ট দেশের চুক্তি হওয়া আইনি প্রতিষ্ঠানের কাছে পাঠানো হবে। তারা সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে উপস্থাপন করার মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া শেষ করবেন। তারপর ফিরবে পাচার হওয়া অর্থ।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, এরই মধ্যে কয়েকটি গ্রুপের সিঙ্গাপুরে পাচার করা অর্থের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেসব অর্থ ফেরত পেতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেশটির সঙ্গে যোগাযোগও করা হয়েছে। এতে সিঙ্গাপুর পাচারের অর্থ ফেরত দিতে সম্মত রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। সেক্ষেত্রে অবৈধ বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দিতে ওই টাকার ভ্যাট-ট্যাক্স কেটে রাখবে দেশটি।
সূত্র বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী ফারুক খানের ভাই আজিজ খানের সামিট গ্রুপ টেলিকম, বিদ্যুৎ ও বন্দর খাতে ব্যাপক অনিয়ম করেছে। তিনি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনী ব্যবসায়ীদের একজন। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশের বাইরে টাকা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনুমতিই নেয়নি সামিট গ্রুপ বা আজিজ খান। অর্থাৎ দেশের বাইরে তিনি যে সম্পদ নিয়েছেন, পুরোটাই পাচার। অনুসন্ধানে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে সামিটের নামে-বেনামে সম্পত্তি থাকার প্রমাণ মিলেছে। গ্রুপটি শুধু সিঙ্গাপুরে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও অনুমতি রয়েছে মাত্র ৭০ মিলিয়ন ডলারের। বাকি ১ দশমিক ৫ বিলিয়নই অবৈধ।
একই অবস্থা চট্টগ্রামের বিতর্কিত এস আলম গ্রুপের। প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুরেই প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে সিংহভাগ বিনিয়োগই অবৈধ। এ গ্রুপটির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন। সরকারের একাধিক সংস্থার পক্ষ থেকে তদন্তে সিঙ্গাপুর, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সাইপ্রাস, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় তাদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের সন্ধান মিলেছে। এসব সম্পদের উৎসসহ কোনো তথ্য নেই।
তথ্য বলছে, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের যুক্তরাজ্যে ৮ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ড (১ হাজার ১৩ কোটি টাকা) পাচারের তথ্য রয়েছে। লন্ডনে সালমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের নামে সাড়ে ৭৭ লাখ পাউন্ডের (১২৬ কোটি টাকা) দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। নাসা গ্রুপের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে ব্যাংক ঋণের ৬৭০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য রয়েছে। নাসা গ্রুপ যুক্তরাজ্য এবং দেশটির অধীন আইল অব ম্যান ও জার্সি এবং চীনের বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল হংকংয়ে ৩ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড বা ৬৪৪ কোটি টাকার সম্পদ পাচার করেছে।
এ ছাড়া সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের মালিকানাধীন কোম্পানি আরামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সিঙ্গাপুরে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ পাচারের তথ্য মিলেছে। এসব সম্পদ উদ্ধারে তিনটি দেশের সঙ্গে এমএলএআর পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেমকন গ্রুপের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে আমরা তৎপর। তবে এখনই কোন দেশ থেকে টাকা ফেরত আসছে, সে বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় হয়নি। নতুন কোনো আপডেট থাকলে জানানো হবে।’
যেভাবে ফিরবে পাচারের টাকা
বাংলাদেশে যে ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারি হয়েছে, তা বিশ্বে নজিরবিহীন। এজন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্ত ও পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা করতে আগ্রহী। প্রয়োজনে যে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে কয়েকটি সংস্থা। যুক্তরাজ্য সরকার, আইএমএফ, এডিবি, বিশ্বব্যাংক, ইউএস ট্রেজারি, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)—সবাই সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।বিএফআইইউ সূত্রে জানা গেছে, পাচার অর্থ ফেরত আনা হয় পাঁচটি ধাপে। প্রথম ধাপ—অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা। দ্বিতীয় ধাপ—সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তৃতীয় ধাপ—সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে অভিযোগ তদন্ত ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। চতুর্থ ধাপ—আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু এবং পঞ্চম ধাপে অর্থ আদায়।
বাংলাদেশ বর্তমানে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিচ্ছে। এ জন্য বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউর গঠিত টাস্কফোর্স, সিআইডি, দুদক এবং এনবিআর একসঙ্গে কাজ করছে। অভিযোগ তদন্তসহ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শেষে বিচারিক কাজে আদালতে পাঠানো হবে তথ্যগুলো। এরপর আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশে থাকা সম্পদ ক্রোক করে বিক্রি করা হবে। এসব অর্থ দিয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধ করা হবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আদালতের রায় পাঠানো হবে পাচার হওয়া দেশে। এরপর ওই দেশের আইন মেনে পরে আদালতে যাবে এজেন্ট। ওই আদালতের রায় অনুযায়ী দেশে ফিরবে পাচার হওয়া অর্থ।
বিএফআইইউর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অর্থ পাচারের বিষয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। সেইসঙ্গে যেখানে পাচার করেছেন, সেখান থেকে যে কোনো মাধ্যমে সঠিক তথ্যটি পেতে হবে। সেখানকার তথ্য পাওয়ার পর দুদেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পারস্পরিক তথ্য বিনিময় করবে; কিন্তু এসব গোপন তথ্য আদালতে দেওয়া যায় না। তাই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের কাছে অনুরোধ করতে হয়। সেটা দিয়ে আদালতে উপস্থাপনের মতো করে তথ্য আনতে হয়।
গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি মনে করেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। তবে এ জন্য বাংলাদেশ এবং সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা থাকতে হবে। দুই দেশের মধ্যে আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই নিজ দেশের আদালতের নির্ভরযোগ্য নথিপত্র উপস্থাপন করতে হবে। কারণ, পাচার হওয়া অর্থ দেশে নয়, রয়েছে বিদেশে।তিনি বলেন, টাকা ফেরত আনতে হলে অবশ্যই আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। তবে প্রশ্ন হলো—আদালতে উপস্থাপনের মতো শক্তিশালী ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে এগোনো হচ্ছে কি না। এ দিকটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তড়িঘড়ি করে কিছু নথি জমা দিয়ে মামলা করলেই কাজ হবে না।জনির মতে, প্রাথমিক ধাপগুলো সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন না হলে পুরো উদ্যোগ ব্যর্থ হতে পারে। অতীতেও এমন উদাহরণ দেশে বহুবার দেখা গেছে। তাই প্রথম থেকেই সুপরিকল্পিত ও তথ্যনির্ভর প্রক্রিয়ার ওপর জোর দেন তিনি।