পদে প্রশাসক, কাজে দুর্নীতির কারিগর

গত সরকারের আমলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কিছু উপসচিব বেপরোয়া দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও শীর্ষ মহলের প্রশ্রয়ে তারা পার পেয়ে যান। তদন্ত তো দূরের কথা, কারও কারও ক্ষেত্রে দুর্নীতির অনুসন্ধানকেই ধামাচাপা দেওয়া হয়। আর চাকরির মেয়াদ শেষের দিকে তারা প্রায় সবাই পদোন্নতি পেয়ে সচিব ও সিনিয়র সচিবের মতো প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় পদে পৌঁছে গেছেন।

কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি, সরকারি সম্পত্তি বেদখলে সহায়তা, নিয়োগে ঘুষ গ্রহণ, ভূমি অধিগ্রহণের অর্থ আত্মসাৎ, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অপব্যবহার থেকে শুরু করে নারী কেলেঙ্কারির মতো গুরুতর অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছিলেন কিছু জেলা প্রশাসক (ডিসি)। তাদের কর্মকাণ্ডে জনপ্রশাসনের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। এখন এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার আমলনামা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ১২০ জন কর্মকর্তার দুর্নীতির তদন্তে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থাকে চারটি চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। এসব তালিকার মধ্যে একটি তালিকায় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পাঁচজন অতিরিক্ত সচিব, আরেকটিতে আটজন সাবেক বিভাগীয় কমিশনার, তৃতীয়টিতে ৪৩ জন সাবেক ডিসি এবং চতুর্থ তালিকায় ৬৪ জন সাবেক ডিসির নাম রয়েছে।

পৃথক চিঠিতে এসব কর্মকর্তার বিষয়ে বর্তমানে দুর্নীতি-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ বা বিষয় তদন্তাধীন আছে কিনা, থাকলে এর তথ্য, না থাকলে দুর্নীতি-সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এ-সংক্রান্ত তথ্যসহ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য দুদক চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়।এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান বলেন, ‘ডিসি তো বটেই, আওয়ামী লীগ আমলে আরও যেসব কর্মকর্তা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তাদের সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) রেহেনা আকতারের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের সময় বালুমহাল থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন আদায় এবং লোকাল রিলেশন্স (এলআর) ফান্ডের নামে কোটি কোটি টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। বালুমহাল ইজারার বিপরীতে তিনি ৫ শতাংশ কমিশন হিসাবে কয়েক কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই তিনি মানিকগঞ্জে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জানা গেছে, গত ৩০ মে মানিকগঞ্জের ৭টি বালুমহাল ২১ কোটি ৪৩ লাখ ৮১ হাজার ৬১১ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। সেই ইজারার কার্যাদেশ আটকে রেখে ইজারাদারদের কাছ থেকে ৫ শতাংশ কমিশন আদায় করেন তিনি। এর আগেও, ২০২৩ সালে এসব বালুমহাল থেকে ৩ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

এই কমিশন বাণিজ্যে ডিসি রেহেনা আকতারের সহকারী (সিএ) শরীফ এবং অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শাখার সিএ বজলু জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন হাট-ঘাট ইজারা, লঞ্চ-বাস-ট্রাকসহ পরিবহন সংগঠন, ইটভাটা, জলমহালসহ বিভিন্ন ক্রয় কমিটি থেকে কমিশন নিয়েছেন এই ডিসি। বিভিন্ন চাকরির নিয়োগেও বিপুল টাকা ঘুষ নিয়েছেন। তবে এসব অভিযোগের কোনো তদন্ত করেনি সরকার। সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী রেহেনা ডিসি থাকাকালে স্থানীয় এমপিদের সঙ্গে মিলে টেন্ডারবাজি ও ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন।

চট্টগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামানের বিরুদ্ধেও বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জানুয়ারিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চট্টগ্রামের বৈষম্যবিরোধী সাংবাদিক ঐক্যের পাঠানো অভিযোগপত্রে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ফখরুজ্জামানকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের ডিসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ভোটারবিহীন নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে সরাসরি সহায়তা করেন। পাশাপাশি তিনি আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনৈতিক কাজে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

দুদকের মামলায় কারাগারে রয়েছেন যশোরের সাবেক ডিসি মুহিবুল হকও। এই দাপুটে আমলা গত সরকারের আমলে হয়েছিলেন সচিবও। গত বছরের ২০ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএস থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যুবদল নেতা শামীম হত্যার ঘটনায় পল্টন থানার মামলায় পরদিন তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। এর পর তাঁকে দুদকের মামলাসহ কয়েকটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন রাজশাহীর সাবেক ডিসি আবদুল জলিলও। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িয়ে তিনি কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশে রাজশাহীর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার ইমতিয়াজ হোসেন তদন্ত করেন। তবে তদন্তে তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়া হয়।

২০১৬ সালে নরসিংদীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে আবু হেনা মোরশেদ জামানের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সেই সময় নরসিংদী জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক গণশুনানিতে ভূমি, গ্যাস, পাসপোর্ট, বিআরটিএ, সদর হাসপাতালসহ ১০টি সেবা খাতে তার বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ তুলেছিলেন উপস্থিত ভুক্তভোগীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গণশুনানির মঞ্চ থেকেই ডিসির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের ঘোষণা দেন তখনকার দুদক কমিশনার ড. নাসির উদ্দীন আহমেদ।গণশুনানিতে জেলা সদরে অস্তিত্বহীন ক্যান্ডেল লাইট স্কুল অ্যান্ড কলেজের নামে কম দামে ৮৫ শতাংশ জমি বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয় তার বিরুদ্ধে। জানা যায়, ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা মূল্যের ওই পুকুর শ্রেণির জমিকে ভিটে শ্রেণি হিসেবে উল্লেখ করে বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া চালান তিনি।এছাড়া, জাতীয়ভাবে বেগম রোকেয়া পদক প্রদানের ক্ষেত্রে নরসিংদী জেলার কোনো নারীর নাম না দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে চট্টগ্রামের বাসিন্দা নিজের মা দিল আফরোজের নাম প্রস্তাব করেছিলেন বলেও অভিযোগ ওঠে।

২০১৮ সালে সরকারি তহবিলের ১৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে কিশোরগঞ্জের সাবেক ডিসি মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। সাবেক ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা (এলএও) সেতাফুল ইসলাম ১৬৪ ধারায় ডিসির বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন আদালতে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সেতাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কথামতো তারা দু’জনসহ কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং এই টাকার বেশির ভাগ অন্যরা নিয়ে গেছেন।

তদন্তের নামে অভিযোগ ধামাচাপা
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাধিক দাপুটে জেলা প্রশাসক (ডিসি) বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তদন্তের নামে এসব অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়া হয়। বরিশালের সাবেক ডিসি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে সংযুক্ত যুগ্ম সচিব মনির হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি পাঠানো হয়। গাজীপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক এ এ আলম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বেগম ফারজানা মান্নান এবং নরসিংদীর সাবেক ডিসি আবু হেনা মোর্শেদ জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত করেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার। কিশোরগঞ্জের সাবেক ডিসি সিদ্দিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও তদন্ত করেন একই কমিশনার। বান্দরবান পার্বত্য জেলার ডিসি দিলীপ কুমার বণিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার। গাইবান্ধার সাবেক জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় (স্মারক নম্বর-৪৮৭) এবং রংপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে দেওয়া হয় রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে।

টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করেন রংপুর বিভাগীয় কমিশনার। জয়পুরহাটের সাবেক জেলা প্রশাসক মো. আ. রহিমের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর-২২৭) রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। লালমনিরহাটের সাবেক ডিসি হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় (স্মারক নম্বর-২২৪) রংপুর বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়। চট্টগ্রামের সাবেক ডিসি সামসুল আরেফিন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল এবং লক্ষ্মীপুরের সাবেক ডিসি এ কে এম টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে। সিলেটের সাবেক ডিসি জয়নাল আবেদীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ (স্মারক নম্বর-১৭৩) তদন্ত করেন সিলেট বিভাগীয় কমিশনার। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব তদন্তের প্রতিটিতেই সংশ্লিষ্ট ডিসিদের রেহাই দেওয়া হয় এবং পরে তারা ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

দুর্নীতি প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ এবং সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাঠ প্রশাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং এ পদে দায়িত্ব পালনকালে যদি বিধিবিধানের বাইরে গিয়ে কাজ করা হয় বা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়ানো হয়, তবে এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, যদি এটি না হয়, তবে মাঠ প্রশাসনে ভুল বার্তা চলে যাবে এবং অন্যরাও দুর্নীতিতে উৎসাহিত হবে। বিলম্ব হলেও তদন্তের পথে বাধা নেই। তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, শুধু ডিসিদের দুর্নীতি নিয়ে কেন তদন্ত হবে? অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরও দুর্নীতির তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, আমার ধারণা, টাকার অঙ্কে দুর্নীতির ব্যাপকতা অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও কম হবে না। তাই সব ক্যাডারের কর্মকর্তাদেরই দুর্নীতির বিচার হওয়া জরুরি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!