কারাগারে বন্দি তিনি—তবে সাধারণ বন্দি নন, ভিআইপি বন্দি। পেয়েছেন ডিভিশন সুবিধাও। কিন্তু জরাজীর্ণ কারাগারে তার থাকা সম্ভব নয়। তাই নিজের জন্য বিশেষ কক্ষে বসিয়েছেন টাইলস, লাগিয়েছেন এসি। দিন-রাত অবাধে সাক্ষাৎ করছেন তার লোকজন। কারাগারের খাবার মুখে তোলা তার পক্ষে অসম্ভব। তাই নিয়মিত বাইরে থেকে আসে খাবার। এসবই কারা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। শুধু তাই নয়, গত কোরবানির ঈদে ৭৭০ জন কয়েদি ও বন্দিকে তিনি দিয়েছেন এক হাজার টাকা করে উপহার। কোরবানির জন্য এনেছেন দু’টি বড় গরু খাইয়েছেন সবাইকে। কারারক্ষী থেকে কয়েদি, এমনকি কারাগারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তার অনুগত।
এক সময় নোয়াখালী জেলা নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। এখনো জেলের ভেতর থেকেই নিয়ন্ত্রণ চালান, আর পুরো কারাগার যেন তার হাতের মুঠোয়। এসব অভিযোগে একবার তাকে কাশিমপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হলেও বেশিদিন সেখানে থাকতে হয়নি। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ফিরে আসেন নোয়াখালী কারাগারে। এতসব ঘটনার নেপথ্যে যার নাম, তিনি নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক চারবারের এমপি একরামুল করিম চৌধুরী।
কারাগারে টাইলস ও এসি বসানো নিয়ে কথা হয় জেলার মোহাম্মদ ফরিদুল ইসলাম রুবেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, টাইলস বসিয়েছে গণপূর্ত বিভাগ, আর এসি লাগানোর খবর সঠিক নয়। অন্য কোনো তথ্য জানতে হলে জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে তিনি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে প্রশিক্ষণে আছেন।
এদিকে শহরে আলোচনা চলছে, জেল সুপার নাকি সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গেছেন একরামের অর্থায়নে, এমনকি সঙ্গে গেছেন একরামের স্ত্রীও। তবে জেলার রুবেল এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, এসব সত্য নয়। তিনি আরও জানান, মাত্র দশ মাস হলো নোয়াখালী কারাগারে যোগ দিয়েছেন, এর মধ্যেই হঠাৎ বদলি হয়ে যাচ্ছেন কুমিল্লায়। কেন এত অল্প সময়ে বদলি করা হলো, সেটি তার কাছেও পরিষ্কার নয়।
ওদিকে টাইলস লাগানোর ব্যাপারে জেলার গণপূর্ত বিভাগের সঙ্গে কথা বললেও নেয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, টাইলস লাগানোর সঙ্গে গণপূর্ত বিভাগ জড়িত নয়। আমরা এ ব্যাপারে জানিও না। এ ব্যাপারে কারাগারের উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) রেজাউল করিম রাজু জানান, গত দুই বছরে কারাগারে কোনো কাজ করেনি গণপূর্ত। টাইলস বা এসি লাগানোর বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ কিছুই জানে না।
সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরী ২০০৮ সাল থেকে চারবার নির্বাচিত হয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে নোয়াখালীতে তিনি গড়ে তোলেন নিজের প্রভাবশালী বলয়। জেলা জুড়ে তার নিয়ন্ত্রণে ছিল কিশোর গ্যাং ও বিভিন্ন গ্রুপ, যারা তার নির্দেশে খুন, রাহাজানি থেকে শুরু করে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছিলেন তার পাশের আসনের এমপি। স্থানীয়দের ভাষ্য, ওবায়দুল কাদেরও তাকে সমঝে চলতেন। এক পর্যায়ে ওবায়দুল কাদেরের ভাই, বসুরহাট পৌরসভার মেয়র মির্জা কাদেরের সঙ্গে একরামের প্রকাশ্য বাকযুদ্ধ দেশজুড়ে আলোচিত হয়। এ ঘটনার পর মির্জা কাদের কোম্পানীগঞ্জ থানায় একরামুলসহ ৯৬ জনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। সেখানে অভিযোগ করা হয়, একরাম ও তার সহযোগীরা তাকে এবং তার নেতাকর্মীদের হত্যা ও লাশ গুমের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
স্থানীয়রা জানান, গত ১৬ বছরে নোয়াখালী শহরে একরামুল করিম চৌধুরীর ইশারাতেই সবকিছু চলত। ভিন্নমতের কোনো সুযোগ ছিল না; বিরোধী মত দমন করে তিনি একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করেন। নিজের অবস্থান আরও শক্ত করতে পরিবারের সদস্যদের বসান বিভিন্ন পদে—স্ত্রী শিউলী একরামকে বানান কবিরহাট উপজেলা পরিষদের টানা তিনবারের চেয়ারম্যান, ভাগ্নে জহিরুল হক রায়হানকে বানান কবিরহাট পৌরসভার মেয়র (যিনি আগে বিএনপি নেতা ছিলেন) এবং পুত্র সাবাব একরামকে বানান সুবর্ণচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। সাবাবও নানা বিতর্কিত ঘটনায় জড়িত ছিলেন—২০১৮ সালে ঢাকার মহাখালীতে তার গাড়ির ধাক্কায় এক ব্যক্তি নিহত হয়ে পরে ৩০ লাখ টাকায় সমঝোতার অভিযোগ ওঠে, আর ২০১৯ সালে মায়ের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর অনুসারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্বামী, স্ত্রী ও ছেলে যখন দু’টি উপজেলার চেয়ারম্যান, তখন তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তির সামনে কেউ টিকতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকাকালে একরামের বিরুদ্ধে টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্য, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে, আর এসবের মাধ্যমে তিনি হয়ে ওঠেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক—যা নিয়ে পত্রপত্রিকায় অসংখ্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু একরামের এমন শক্তিশালী দুর্গ একদিন ভেঙে পড়বে, তা কেউ ভাবেনি। কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে একদফার আন্দোলন—পরিস্থিতি বদলে যায় দ্রুত। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ পুরো চিত্রই পাল্টে দেয়। পালিয়ে যান একরামুল করিম চৌধুরীও। তবে দুই মাসের মধ্যেই চট্টগ্রামের খুলশি থানার আবদুল মালেক লেন এলাকা থেকে র্যাব তাকে গ্রেপ্তার করে নোয়াখালী কারাগারে নিয়ে আসে। কারাগার সূত্র জানায়, ১৯৬৯ সালে নির্মিত এ কারাগারে রয়েছে তিনটি ভিআইপি কক্ষ, যেখানে সাধারণত ডিটেনশনপ্রাপ্তদের রাখা হয়। এর মধ্য থেকে একটি রাজকীয় কক্ষ বরাদ্দ পেয়েছেন একরামুল করিম চৌধুরী, যেখান থেকে তিনি এখনো নোয়াখালী নিয়ন্ত্রণের কাজ করে যাচ্ছেন।
অতি সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন রিয়াদ নামের এক রাজনৈতিক কর্মী। তিনি জানান, সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর কক্ষ সাধারণ রুম নয়—এ যেন কারাগারের ভেতরের বেহেশতখানা। তিনি বলেন, একরাম যে কোনো আসামিকে বাইরে বের হলে ১০০০ টাকা করে দেন। এছাড়া মাঝে মাঝে গরু জবাই করে কারাবন্দিদের খাওয়ান।