বাটারফ্লাইয়ের শত কোটি টাকার করফাঁকি

এক প্রতিষ্ঠানের পণ্য অন্য প্রতিষ্ঠানে

** ডিস্ট্রিবিউটর, পরিবেশকের কাছে পণ্য বিক্রয়ের সময় উৎসে কর কর্তন করা হয় না
** কারখানায় বিনিয়োগ ১৭৫ কোটি টাকা, আয়কর রিটার্নে উৎসে কর দেখানো হয়নি
** বাটারফ্লাই মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেড ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৪৮ কোটি টাকা

দেশের বাটারফ্লাই গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বাটারফ্লাই ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে প্রায় শত কোটি টাকার উৎসে আয়কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অভিনব কৌশলে প্রতিষ্ঠানটি র্দীঘদিন ধরে কর ফাঁকি দিয়ে আসছে। ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি পণ্য উৎপাদনের পর মার্কেটিং কোম্পানিকে ‘চুক্তি ছাড়া ফ্যাক্টরি রেটে’ সরবরাহ করতো। নিজেদের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদানের কারণে ডিস্ট্রিবিউটর বা পরিবেশক পর্যায়ে উৎসে আয়কর আদায় করতো না।

২০১৩-১৪ কর বর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ কর বর্ষ পর্যন্ত ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৯৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৪২ টাকার উৎসে কর ফাঁকি দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি র্দীঘদিন ধরে অভিনব কৌশলে এ ফাঁকি দিতে আসছেও কেউ জানতে পারেনি। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যের ভিত্তিতে কর অঞ্চল-৮ বাটারফ্লাই ম্যানুফ্যাকচারিং এর আয়কর ফাইল পুন: উম্মোচন করলে বিষয়টি ধরা পড়ে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ জারি করা হয়েছে।

এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, ওই সময়কার অ্যাসেসমেন্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছেন কিনা তা দেখার দরকার। অপরদিকে বাটারফ্লাই ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে ১৭৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য গোপন করে কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একই অভিযোগে প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ জারি করা হয়েছে। এছাড়া গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বাটারফ্লাই মার্কেটিং কোম্পানি লিমিটেডের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ভ্যাট (সুদ প্রায় ১৪ কোটি ৭২ লাখ) ফাঁকি উদঘাটন করে।

এ বিষয়ে গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ মান্নান আয়কর ফাঁকির বিষয়টি প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে অফিস সময়ে ফোন দেওয়ার জন্য বলেন। কয়েকদিন ধরে অফিস সময়ে ফোন, খুদে বার্তা দেওয়া হলেও জবাব দেননি। সর্বশেষ গতকাল ফোন দেওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না। আমাকে দয়া করে আর বিরক্ত করবেন না।’ তবে গ্রুপের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা উচ্চ আদালতে গিয়েছি। এখনো সমাধান হয়নি।

আয়কর অধ্যাদেশের ৫৩(ই) ধারা অনুযায়ী, ডিস্ট্রিবিউটর বা পরিবেশক বা অন্য কোন ব্যক্তির কাছে পণ্য বিক্রয় করা হলে পণ্য বিক্রয়কালে উৎপাদনকারী কোম্পানি নির্দিষ্ট হারে উৎসে কর কাটা বাধ্যতামূলক এবং ওই উৎসে কর ২১ দিনের মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার নিয়ম রয়েছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৯ সালের ২৫ জুন কোম্পানির প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করে আয়কর কর্মকর্তারা। পরিদশর্নে কর্মকর্তারা দেখতে পায়, প্রতিষ্ঠানটি কখনোই উৎসে কর কর্তন করে সরকারি কোষাগারে জমা দেয়নি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ম্যানুফেকচারিং কোম্পানি মার্কেটিং কোম্পানিকে ফ্যাক্টরি রেটে পণ্য বিক্রয় করে, এক্ষেত্রে উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি হয় না। অথচ পণ্য বিক্রয় আইন ১৯৩০ অনুযায়ী, এক প্রতিষ্ঠান তার অপর প্রতিষ্ঠানে পণ্য স্থানান্তর মানে পণ্যের মালিকানা সম্পূর্ণরূপে স্থানান্তরিত হওয়া। আর কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান দুটিও আলাদা সত্ত্বা।

এর প্রেক্ষিতে কর কর্মকর্তারা ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ কর বছর পর্যন্ত আয়কর রিটার্নের সঙ্গে জমা দেয়া অডিট রিপোর্ট নিরীক্ষা করে। এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ৬ অর্থবছরে ৫৯ কোটি ৩৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৫ টাকা উৎসে কর জমা দেয়নি। আর নির্ধারিত সময় উৎসে কর জমা না দেয়ায় ২ শতাংশ সরল সুদ ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ ৬০৭ টাকা (২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত)। ফলে সর্বমোট কর ফাঁকির পরিমাণ দাড়ায় ৯৭ কোটি ৭৮ লাখ ৫১ হাজার ৪২ টাকা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যা, বক্তব্য ও প্রমাণাদি চেয়ে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর কর অঞ্চল-৮, সার্কেল-১৫৬ থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর নোটিশ দেওয়া হয়। ২১ অক্টোবরের মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। তবে প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকির টাকা পরিশোধ না করে উচ্চ আদালতের শরাণাপন্ন হয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্রমতে, বাটারফ্লাই গ্রুপ শুরুতে ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানি করতো। এলজি, হাইসেন্স ব্রান্ডের সামগ্রী বিদেশ থেকে আমদানির পর নিজস্ব চ্যানেলে তা বিক্রি করতো। পরে ইকোপ্লাস নামে স্থানীয় ব্রান্ড চালু করে।

এনবিআর সূত্র জানায়, বাটারফ্লাই ম্যানুফেকচারিং কোম্পানির কারখানা ময়মনসিংহের ভালুকায়। এখানে এসি, ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, ফ্যান, ইলেকট্রিক আয়রন ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স বানানো হয়। এই কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের প্রকৃত তথ্য গোপন করে আবার কর ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কারখানা নির্মাণে ২০১৩-১৪ করবর্ষে মোট ১৭৫ কোটি ৭১ লাখ বিনিয়োগ করা হয়। কাঁচামাল ক্রয়, প্লান্ট ও মেশিনারিতে বিনিয়োগের বিপরীতে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা উৎসে দেয়ার কথা থাকলেও রিটার্নে ৮০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা প্রদর্শন করে। এর প্রেক্ষিতে বিনিয়োগের প্রকৃত চিত্র গোপনের জন্য ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর একই সার্কেল থেকে ব্যাখ্যা, বক্তব্য ও প্রমাণাদি চেয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি দেয়া হয়।

অপরদিকে বাটারফ্লাই গ্রুপের বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেডের ভ্যাট ফাঁকি উদ্ঘাটন করে সিআইসি। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ৬২ কোটি ৯০ লাখ ৬১ হাজার ২৪৫ টাকার (ভ্যাট ৪৮ কোটি ১৭ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৬ টাকা ও সুদ ১৪ কোটি ৭২ লাখ ৭৩ হাজার ৫৩৯ টাকা) ভ্যাট ফাঁকির মামলা করে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)। পরে ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ ভ্যাট কমিশনারেট দাবিনামা জারি করে। বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেড ২০০৮-৯ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত বিভিন্ন সেবার বিপরীতে প্রকৃত বিক্রয় তথ্য গোপনের মাধ্যমে এ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৭ সালে দাবিনামা চূড়ান্ত করা হয়। পরে প্রতিষ্ঠান ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট পরিশোধ না করে ট্রাইব্যুনালে আপীল করে। ট্রাইব্যুনালে এনবিআরের পক্ষে রায় দেওয়ার পর প্রতিষ্ঠান ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করে দেয়। কিন্তু সুদের টাকা পরিশোধ করেনি। এ নিয়ে প্রতিষ্ঠানকে দাবিনামা জারি করা হয়। তবে দায় স্বীকার করে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েও পরবর্তীতে তা ফেরত নিতে কর্মকর্তাদের ঘুষ প্রদান করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য একজন ভ্যাট পরামর্শকের সঙ্গে ৩ কোটি টাকা কন্টাক্ট করে প্রতিষ্ঠানটি।

অপরদিকে বাটারফ্লাই গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাজারে এলজি ব্রান্ডের পণ্য আমদানি করে বাজারজাত করছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ দিয়ে এসব পণ্য খালাস হয়। তবে এসব পণ্য মিথ্যা ঘোষণায় খালাস করার অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন ডেপুটি কমিশনারকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এই অনিয়ম তদন্তে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সূত্রমতে, চট্টগ্রাম কাস্টম অন্যান্য ব্রান্ডের পণ্যের ক্ষেত্রে ৩০ ডলার করে ভ্যালু পুনর্নির্ধারণ করলেও বাটারফ্লাইয়ের পণ্য ১৮ ডলার করেন। সুইং হেড মেশিন রিনউন ব্র্যান্ডের ক্ষেত্রে ৩০ ডলার নির্ধারণ করলেও বাটারফ্লাইয়ের ক্ষেত্রে তা ১৮ ডলার ও ২০ ডলারে শুল্কায়ন করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে সরকারের, অন্যদিকে অন্য ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!