অভিনব জালিয়াতির মাধ্যমে নাবিল গ্রুপ প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশই বেনামি। আরও ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যেও রয়েছে নানা অনিয়ম, বিশেষ করে জামানত জালিয়াতি। সাধারণত জামানত বন্ধকের পর ঋণ দেওয়া হয়, কিন্তু এখানে উল্টো প্রক্রিয়ায় আগে ঋণ দেওয়া হয়েছে, পরে নেওয়া হয়েছে জামানত। ঋণের অর্থ দিয়ে খোলা এফডিআরকেই সেই ঋণের জামানত হিসেবে দেখানো হয়েছে। ঋণখেলাপি হলে এফডিআর ভেঙে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে নবায়ন করার মতো চাঞ্চল্যকর জালিয়াতির অভিযোগও উঠেছে। এতে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতার প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া, জামানতের মূল্য ছিল খুবই কম। এ ঋণ জালিয়াতির টাকা দিয়ে গ্রুপটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেআইনিভাবে ১ হাজার একর জমি কিনেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অভিযোগ রয়েছে, তিনটি ব্যাংক থেকে নেওয়া এসব ঋণের অর্থ একাধিক হাত ঘুরে এস আলম গ্রুপের হিসাবে যায় এবং পরে বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে পাচার করা হয়।
গ্রুপটির নামে-বেনামে নেওয়া মোট ঋণের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার খেলাপি হয়ে গেছে। নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ না করায় আরও ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার পথে। উল্লেখ্য, এই গ্রুপের ঋণের স্থিতি এখন পর্যন্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। নাবিল গ্রুপ রাজশাহীভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান হলেও এটি ঋণ নিয়েছে চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী শহরের ব্যাংকের শাখা থেকে। এছাড়া আরও একটি জেলার শাখা থেকেও ঋণ নিয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করতে গ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
সরকারের একাধিক সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।নাবিল গ্রুপের নানা ধরনের জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডি তদন্ত করছে।
এদিকে ভিন্ন একটি সূত্রে জানা যায়, নাবিল গ্রুপের একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে একটি মামলা চলমান। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশ থেকে বিভিন্নভাবে যেসব টাকা পাচার করা হয়েছে সেগুলো বিদেশি বিনিয়োগের নামে দেশে আনা হয়েছে। এ বিষয়ে আরও বিশদ তদন্ত দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে নাবিল গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বিদেশে কোনো সম্পদ রয়েছে কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করছে বিএফআইইউ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা তিনটি ব্যাংক থেকে নাবিল গ্রুপ এসব ঋণ নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। এছাড়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকেও গ্রুপটি মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে দেড় হাজার কোটি টাকার ঋণ শনাক্ত করা হয়েছে। সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক দিয়েছে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে আরও সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে বলে জানা গেছে। এগুলো নিয়ে আরও বিশদ তদন্ত চলছে। নাবিল গ্রুপের প্রতিটি ঋণের নেপথ্যে ছিল এস আলমের হাত। এসব ঋণের সুবিধাভোগী যেমন নাবিল গ্রুপ, তেমনি এস আলম গ্রুপও নাবিল গ্রুপের ঋণের বিপরীতে নানা সুবিধা নিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নাবিল গ্রুপের ঋণের টাকা কয়েক হাত ঘুরে এস আলমের হিসাবে গেছে।
বিএফআইইউর তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নাবিল গ্রুপের নামে তিনটি ব্যাংকে ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণে বড় ধরনের জালিয়াতি পাওয়া গেছে। এসব ঋণের মধ্যে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকাকে ইতোমধ্যে খেলাপি করা হয়েছে। নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ না করায় এখন আরও ছয় হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হওয়ার পথে রয়েছে।
ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে নাবিল গ্রুপের অস্তিত্ববিহীন দুটি কোম্পানির নামে ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে ২ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। গ্রুপের আরও একটি বেনামি প্রতিষ্ঠান নাবা এগ্রো ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ১৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে ইসলামী ব্যাংক থেকে। ঠিকানা রাজশাহী দেওয়া হলেও সেখানে এই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আলোচ্য ঠিকানায় নাবিল গ্রুপের একটি আবাসিক ভবন পাওয়া গেছে। এতে কোনো কোম্পানির অফিস নেই।
এছাড়া রাজশাহী শহরের বিভিন্ন শাখা থেকে গ্রুপের বেনামি প্রতিষ্ঠান আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল প্রডাক্ট প্যালেস, এজে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও আনোয়ারা ফিড মিলস লিমিটেডের নামে মোটা অঙ্কের ঋণ নেওয়া হয়েছে এই ব্যাংক থেকে। নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের নামেও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে রাজশাহী শহরের বিভিন্ন শাখা থেকে। এসব ঋণ স্বনামি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া হলেও এগুলোতে যথেষ্ট জামানত নেই। যেসব জামানত দেওয়া হয়েছে সেগুলোর দাম অতিমূল্যায়িত। যে কারণে ব্যাংক জামানত বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না। কয়েকটি কোম্পানির মালিক বানানো হয়েছে গ্রুপের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও। এছাড়া একেবারেই অপরিচিত ব্যক্তির নামেও কোম্পানি গঠন করে ঋণ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা এস আলমের নির্দেশে এসব অর্থ দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, যেদিন ঋণের টাকা ছাড় করা হয়েছে সেদিনই ওই ঋণের টাকা থেকেই কিছু অংশ ব্যাংকে এফডিআর বা ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়েছে। এই অর্থ ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে দেখানো হয়েছে। অথচ নিয়ম অনুযায়ী ঋণের অর্থ ছাড় করার আগেই এফডিআর জামানত হিসাবে দেওয়ার কথা। কিন্তু নাবিল গ্রুপ তা করেনি। এত বড় ধরনের অনিয়ম করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তারা সহায়তা করেছেন। এতেই শেষ হয়নি জালিয়াতির ধরন। ওইসব ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়নি। ফলে সেগুলো খেলাপি হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এসব খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে ওই এফডিআর ভেঙে ডাউন পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তা এত বড় জালিয়াতির তথ্যেও কোনো আপত্তি দেননি কোথাও। বরং তারা সানন্দে এসব জালিয়াতিতে সায় দিয়েছেন। অর্থাৎ ঋণ নিয়ে ঋণের অর্থে এফডিআর করে জামানত দিয়েছেন। সেই ঋণ খেলাপি হলে ওই জামানতের অর্থ ভাঙিয়ে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নবায়ন করেছেন।
সূত্র জানায়, নাবিল গ্রুপের জালিয়াতির বিষয়ে বিএফআইইউর তদন্তে পাওয়া তথ্য ইতোমধ্যে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের আকারে সরকারের একাধিক সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে আরও গভীর তদন্ত চালাচ্ছে। পাশাপাশি ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য ও দলিলও হস্তান্তর করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত ৯৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকার স্থিতিসহ ৭৩টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়া, ৫৮.৮০ একর জমি তদন্তের অংশ হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। নাবিল গ্রুপের মালিকানায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও ৮৯৪ একর জমি শনাক্ত করা হয়েছে, যা দুর্নীতির তদন্তের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। সব মিলিয়ে গ্রুপটির নামে-বেনামে ১ হাজার একর জমির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।