কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের ‘গডফাদার’ সামছুদ্দিন কালু জেলার শীর্ষ লুটেরা হিসাবে পরিচিত। তিনি নাঙ্গলকোট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সময় তিনি বিভিন্ন অপকর্মে ব্যস্ত ছিলেন। মেয়র ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আসন দখলে রেখে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও নিয়ন্ত্রণ করতেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের হয়রানি, ঘুস কেলেঙ্কারি, ভূমি দখল, টেন্ডারবাজি এবং সরকারি বরাদ্দ লুটে নেওয়াই ছিল তার মূল কাজ।
এছাড়া, তিনি সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং এখনো নাঙ্গলকোটে তার অদৃশ্য প্রভাব বজায় রেখেছেন। বিএনপির কিছু অংশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তার, ফলে তার আধিপত্য অব্যাহত আছে। সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, কালু সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। তার ক্যাডার বাহিনী ছিল অস্ত্রশস্ত্রে সমৃদ্ধ, যার মাধ্যমে তিনি গোটা নাঙ্গলকোটকে এক ধরনের আধিপত্যের মাধ্যমে শাসন করতেন। তাকে ‘সম্রাট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ক্ষমতায় আসার আগে তিনি একজন মৎস্য ব্যবসায়ী ছিলেন, কিন্তু পরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা তাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। তার নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড ছিল মূলত ব্যবসার মতো। বিভিন্ন খাতে তিনি কমিশন আদায় করতেন, সরকারি জায়গা দখল করতেন, টিআর ও কাবিখা লুট করতেন, টেন্ডারবাজি এবং তদবির বাণিজ্যও ছিল তার আয়ের উৎস। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা আয় করেছেন।
তিনি রেলওয়ের মূল্যবান ৫ বিঘা জমি দখল করেছেন এবং সেখানে দোকানপাট করে ভাড়া আদায় করেন। নাঙ্গলকোট পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন এবং সরকারি বরাদ্দের টাকায় বাড়ির আশপাশ পাকা করেছেন। তার নিজ বাড়ির পাশে রয়েছে পেট্রোল পাম্প এবং নাঙ্গলকোট আলট্রা মডার্ন হাসপাতাল।এছাড়াও, তার মালিকানায় রয়েছে কমপক্ষে ৭০ কোটি টাকার মূল্যবান হাজী আলী আকবর সুপার মার্কেট, ১০ একর জায়গায় মৎস্য প্রকল্প, এবং আরও ৪৭টি পুকুর, যার মধ্যে সরকারি ১৭টি খাস দীঘি ও পুকুর রয়েছে। এসব জলাশয় থেকে তিনি কোটি টাকা আয় করছেন।
পৌরসভার মান্দ্রা, হরিপুর, নাঙ্গলকোট মৌজা, গোত্রশাল, তুলা পুকুরিয়া, শ্রীকান্তা এলাকায় ১৫ একর মূল্যবান জমি রয়েছে তার। আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের জ্যাকসন হাইট এলাকায় তার একটি বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেন সিটিতে আধুনিক অ্যাপার্টমেন্ট, উত্তরার প্রিয়াঙ্কা সিটিতে আধুনিক ৫ তলা ভবন, মোহাম্মদপুর নবোদয় হাউজিং প্রকল্পে তিনতলা ডুপ্লেক্স ভবন রয়েছে।
স্থানীয়দের দাবি, কালুর আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, যা শুধু প্রকাশিত সম্পদের বাইরেও বিস্তৃত। তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপুল পরিমাণ অর্থ রাখেন এবং এলাকার লোকজনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে অনেক টাকা পাচার করেছেন।পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর রেজাউল হক রেজু জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে এডিবির অর্থায়নে ১৩৫টি বক্স কালভার্ট প্রকল্প আসে। কালু এসব কালভার্ট থেকে অর্ধেক কমিশন নিয়ে তার তিন সহযোগীর মধ্যে ভাগ করে দেন।উপজেলার হেসাখাল ইউপির ৮নং ওয়ার্ডের সদস্য কাজিম উদ্দিন বলেন, কালু পুরো উপজেলার ইউপি সদস্য প্রার্থীদের কাছ থেকে দুই থেকে পাঁচ লাখ, চেয়ারম্যান প্রার্থীদের কাছ থেকে পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা উৎকোচ হিসেবে নিতেন। যে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হলে তাকে চাঁদা দিতে হতো।
উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম বলেন, নাঙ্গলকোটের সর্বেসর্বা ছিলেন শামসুদ্দিন কালু। তিনি টেন্ডারবাজি, ঠিকাদারি, সালিশ-দরবার, সরকারের উন্নয়ন বরাদ্দ, জায়গা বেচাকেনা, দলের কমিটি বাণিজ্য এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্যসহ প্রতিটি সেক্টরে চাঁদা আদায় করতেন। যদিও লোটাস কামাল এখানে এমপি, তবে বাস্তবে এমপির ক্ষমতা খাটিয়েছেন শামসুদ্দিন কালু। গত ১৫ বছরে তিনি কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। স্থানীয়দের মতে, আমেরিকায় তার একটি বাড়ি এবং ঢাকায় কয়েকটি বাড়ি রয়েছে।
নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব আনোয়ার হোসেন নয়ন বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে কালুর তেমন কোনো বড় সম্পত্তি ছিল না। তবে উন্নয়ন কাজগুলোর ক্ষেত্রে তিনি ১০% কমিশন নিতেন। বর্তমানে তিনি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছেন। তবে অভিযুক্ত সামছুদ্দিন কালু আত্মগোপনে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।