প্রস্তাবিত ট্রাভেল এজেন্সি পরিপত্র বাস্তবায়িত হলে দেশের ৫২শ ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাবে। সম্প্রতি গ্রাহক হয়রানি প্রতিরোধের নামে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা পরিচালনার জন্য একটি খসড়া পরিপত্র তৈরি করেছে। খসড়ায় ব্যবসায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে এতে ৫২শ ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বরং এতে গ্রাহক হয়রানি আরও বাড়বে এবং বিমানের টিকিট বিক্রিতে মনোপলি সৃষ্টি হবে, যা টিকিটের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি হিসাবেই ৫২শ ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হবে, তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। কারণ, সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যন্ত ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা ছড়িয়ে পড়েছে এবং যাদের কম্পিউটার আছে, তারা সাব-এজেন্ট হিসেবে কমিশনভিত্তিক ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এর ফলে ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও বিপর্যয় নেমে আসবে।
অভিযোগ উঠেছে, বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ও আয়াটার (ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন) সদস্য আছে এমন কতিপয় অসাধু ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের সঙ্গে যোগসাজশে একটি সিন্ডিকেট পরিপত্রটি তৈরিতে জড়িত। জানা গেছে, বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার এই ব্যবসায় মনোপলি করার জন্য কৌশলে এই পরিপত্র তৈরি করতে যাচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়বে এই ব্যবসা।
এয়ারলাইন মালিকদের সংগঠন বোর্ড অব এয়ারলাইন রিপ্রেজেন্টেটিভ বাংলাদেশের (বার) নেতারাও এই পরিপত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংগঠনের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, সরকার একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এই সেক্টরকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিচ্ছেন। কিভাবে টিকিটের দাম কমবে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে বারবার নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তার মতে পরিপত্র বাস্তবায়ন হলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
পরিপত্রের খসড়ার (ণ) ধারাতে বলা হয়েছে, এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে টিকিট ক্রয়-বিক্রয় করিতে পারবে না। এই ধারার বিরোধিতা করে ট্রাভেল এজেন্সিগুলো জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ট্রাভেল ব্যবসায় এজেন্ট টু এজেন্ট (বি-টু-বি) মডেল প্রচলিত। সে অনুযায়ী এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট বিক্রি করতে পারে। এই নিয়মের ব্যত্যয় হলে স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবে না। পাশাপাশি এই সেক্টরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দেশে বর্তমানে ৫৭৪৬টি লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৯৭০টি ট্রাভেল এজেন্সি আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহণ সংস্থা আয়াটার (ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন) স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এর মধ্যে শুধু ৩৫০টি ট্রাভেল এজেন্সির কাছে এমিরেটস এয়ারলাইন্স, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, সৌদি অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সসহ বড় বড় এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রির অনুমতি (ক্যাপিং) আছে।এমনকি রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রির অথরিটি পেতে হলে আয়াটাসহ সবমিলে ৪০ লাখ টাকা অগ্রিম জমা দিতে হয়। এছাড়াও এয়ার অ্যারাবিয়া, ইন্ডিগো, সালাম এয়ার, জাজিরা এয়ারওয়েজের মতো বাজেট এয়ারলাইন্স রয়েছে যাদের টিকিট আয়াটাতে পাওয়া যায় না।
এই পরিপত্র বাস্তবায়ন করা হলে দেশের ৫ হাজারেরও বেশি লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট সংগ্রহের জন্য এই ৩৫০টি ট্রাভেল এজেন্সির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। সরকার কর্তৃক লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট ক্রয়-বিক্রয় করতে না পারে সেক্ষেত্রে ৫ হাজারের বেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাঝারি ও ছোট পরিধির প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।
মঈন ট্রাভেলস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী মো. গোফরান চৌধুরী বলেন-জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ বছরের এই প্রথম ৩ মাসে তিনি নিজে মাত্র ৮টি টিকিট ইস্যু করেছেন। বাকি টিকিটগুলো অন্য লাইসেন্সধারী এজেন্সি কেটেছে। শত চেষ্টা করলেও কম টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি থাকার কারণে বড় এয়ারলাইন্সগুলো তাদের টিকিট বিক্রির অথরিটি দেবে না। এই পরিপত্র জারি করলে তাদের ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তিনি বলেন, নতুন বিধিনিষেধ কার্যকর হলে বড় ট্রাভেল এজেন্সিগুলোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। তারা বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগ তৈরি হবে। বিদেশি ট্রাভেল এজেন্সিগুলো এর সুযোগ নেবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিশ্বে কোথাও আয়াটা বাধ্যতামূলক নয়, তাহলে কার স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত? খসড়া পরিপত্রের (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা করার জন্য আবশ্যিকভাবে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন-আয়াটার স্বীকৃতি ও সদস্যপদ নিতে হবে।
এজেন্সিরা বলছে, আয়াটা হচ্ছে একটি টিকিট সেলিং প্ল্যাটফর্ম। পৃথিবীতে দুই ধরনের ট্রাভেল এজেন্সি থাকে। আয়াটা এবং নন-আয়াটা ট্রাভেল এজেন্সি। তবে পৃথিবীর কোথাও ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা করার জন্য আয়াটার মাধ্যমে টিকিট বিক্রি বাধ্যতামূলক নয়।
সাধারণত বড় বড় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো আয়াটার সদস্যপদ লাভ করে। কারণ আয়াটাতে সব এয়ারলাইন্সের টিকিট বিক্রির অথরিটি পেতে হলে কোটি কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টির পাশাপাশি কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়। জানা গেছে, একটি এজেন্সিকে আয়াটার সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে হলে কমপক্ষে ৬ মাস ব্যবসা করতে হয়। পাশাপাশি সর্বনিম্ন ৩০ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টিসহ আরও নানা কাগজপত্র আয়াটার বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার বরাবর জমা দিতে হয়। সব কাগজপত্র ঠিক থাকলে এই ৩০ লাখ টাকার গ্যারান্টিতে মাত্র ৩-৪টি এয়ারলাইন্সের টিকিট কাটার অনুমতি পাওয়া যায়। ট্রাভেল এজেন্সি গ্যারান্টিকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ অর্থাৎ ২১ লাখ টাকার টিকিট কিনতে পারে তারা।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিবন্ধিত এজেন্সিগুলোর মধ্যে ৪৪৭৬টি অর্থাৎ ৮৩ শতাংশ এজেন্সির আয়াটার স্বীকৃতিপত্র নেই। ফলে নতুন পরিপত্র জারির সঙ্গে সঙ্গে এই এজেন্সিগুলো আর টিকিট বিক্রি করতে পারবে না। ফলে টিকিটের সংকট দেখা দেবে, ভোগান্তিতে পড়বেন যাত্রীরা।
এছাড়া, ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে আয়াটার স্বীকৃতিপত্র পাওয়া সব ট্রাভেল এজেন্সিগুলি বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ফেনী, নোয়াখালী ও রাজশাহী শহরে অবস্থান করছে। বর্তমানে, অন্যান্য শহরগুলোতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক ট্রাভেল এজেন্সি অন্য ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট ক্রয়-বিক্রয় করে ব্যবসা পরিচালনা করছে। তবে নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে, দেশের আনাচে-কানাচে থাকা ৫২শ ট্রাভেল এজেন্সির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে, এসব শহরের বাইরের যাত্রীদের টিকিট কেনার জন্য পার্শ্ববর্তী জেলা শহরের আয়াটা ট্রাভেল এজেন্টের কাছে যেতে হবে, যা টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে দেবে। এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ফাতেমা রহিম ভীনা বলেন, পরিপত্র এখনো বাস্তবায়িত হয়নি, এটি খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। তাই এ বিষয়ে এখন কিছু বলা সম্ভব নয়।
আটাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম আরেফ বলেন, খসড়া পরিপত্রের কথা শুনেছি কিন্তু এখনো দেখিনি। তিনি বলেন, যে পরিপত্রের কারণে কোনো ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ হয়ে যাবে সেটা আমরা মানব না। এতে ট্রেডে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। আকাশপথের ব্যবসায় নৈরাজ্য দেখা দেবে। টিকিটের দাম কমানো দূরের কথা উলটো হুহু করে বাড়বে।
তিনি বলেন, সব ট্রাভেল এজেন্সি যাতে ব্যবসা করতে পারে সে ধরনের পরিপত্রকে আমরা স্বাগত জানাব। অন্যথা আমরা মানব না। তার মতে যদি আয়াটা বাধ্যতামূলক করা হয় তাহলে লাইসেন্সধারীরাও বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ সাড়ে ৫ হাজার লাইসেন্সধারী ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যে মাত্র সাড়ে ৩শ সদস্যের আয়াটা আছে বাকিরা সাব এজেন্ট হিসাবে আয়াটা সদস্যদের কাছ থেকে টিকিট ক্রয় করছে। তার মতে মন্ত্রণালয় যদি কোনো পরিপত্র জারি করতে চায় তাহলে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হবে। অন্যথায় সুফল আসবে না।