নগদের ভয়াবহ জালিয়াতি: রাষ্ট্রীয় সমর্থনে টাকা ছাপানো

বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ ভয়াবহ ডিজিটাল জালিয়াতির সাথে জড়িত। রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ই-মানি সৃষ্টি করে নগদ টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। এইভাবে চক্রটি প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে এবং আরও ২,৩৫৬ কোটি টাকা লোপাট করেছে। এর ফলে সৃষ্ট আর্থিক ঘাটতি ডাক বিভাগের উপর চাপানো হয়েছে। এই জালিয়াতিতে নগদকে উৎসাহিত করেছেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এবং তার পুত্র, তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় সরাসরি এর সুবিধা ভোগ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার এসব জালিয়াতিতে চুপ থেকে নগদকে সহায়তা করেছেন। উল্লেখ্য, টাকা ছাপানো এবং বাজারে সরবরাহ করার একমাত্র অধিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের, এবং এই কাজটি কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান করতে পারে না, এমনকি বিশ্বের কোথাও এটি অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান দ্বারা করা হয় না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক তদন্তে নগদের ভয়াবহ জালিয়াতির চিত্র উঠে এসেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের মতে, বাংলাদেশে এ ধরনের জালিয়াতি এই প্রথম। ডিজিটাল মাধ্যমে মানি ক্রিয়েশন বা ই-মানি তৈরি একপ্রকার টাকা ছাপানোর মতো অপরাধ। এ গুরুতর অপরাধের দায়ে নগদের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে একটি মামলা করে, যা অবৈধভাবে টাকা ছাপানোর প্রথম মামলা। এর আগে ২০০১ সালে বেআইনি ব্যাংকিং পরিচালনার অভিযোগে আইটিসিএল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে এখন পর্যন্ত মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নগদের বিরুদ্ধে ২,৩৫৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে পৃথক মামলাও দায়ের করেছে।

সূত্র জানায়, ডাক অধিদপ্তর ও থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী, নগদের ব্যাংক হিসাবে যত টাকা জমা থাকবে, তার সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করার অনুমতি ছিল। তবে নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে নগদ ৬৪৫ কোটি টাকার বেশি ই-মানি ইস্যু করেছে। অনুমোদন ছাড়াই ৪১টি পরিবেশকের হিসাব খুলে ১,৭১১ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়, যাদের মূল দায়িত্ব ছিল সরকারি ভাতা বিতরণ। তবে এই পরিবেশকরা ভাতা বিতরণ না করে উল্টো অর্থ আত্মসাৎ করেছে। বিশেষ করে, ভাতাভোগীরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা উত্তোলন না করলে সেই অর্থ নগদ নিজেরাই তুলে নেয়। অনুমোদনহীন এসব পরিবেশককে ব্যবহার করে জালিয়াতি চালানো হয়। এসব প্রতারণার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২,৩৫৬ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে, তবে তদন্ত চলমান থাকায় এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।

জানা যায়, মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনার জন্য নগদ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে লাইসেন্স চেয়ে পায়নি। পরে ডাক বিভাগের আইন সংশোধন করে তারা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই। পরে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং করার সাময়িক লাইসেন্স নেয়। কিন্তু স্থায়ী লাইসেন্স পায়নি। পরবর্তী সময়ে তারা নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই লাইসেন্স পেয়েছে। অবশ্য একপর্যায়ে তা ফেরত দিয়ে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের লাইসেন্স নিয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই নগদ যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। সবই পেয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র জয়ের হস্তক্ষেপে। নগদ, ডাক বিভাগের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রচারণা চালানো হলেও এটি ডাক বিভাগের কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। ডাক বিভাগের নাম ব্যবহার করে নগদের মালিকপক্ষ প্রতারণা করেছে।

২০১০ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ “নগদ” নামে পোস্টাল ক্যাশ সেবা চালু করে। পরে, মোবাইল ব্যাংকিং চালুর লক্ষ্যে ২০১৭ সালে তারা থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির সঙ্গে চুক্তি করে। ২০২০ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির নাম পরিবর্তন করে নগদ লিমিটেড করা হয়, যা ডাক বিভাগের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে সেবাটি পরিচালনা করে। তবে মালিকানায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা। এর পেছনে মূল ভূমিকা রাখেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়।

নগদ চালুর সময় থার্ড ওয়েভের শেয়ারহোল্ডার হিসেবে যুক্ত হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন দুই সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল। এছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকনের স্ত্রী রেজওয়ানা নূরও শেয়ারহোল্ডার ছিলেন, যদিও পরবর্তীতে তিনি মালিকানা ছেড়ে দেন।

২০১৮ সাল থেকে নগদকে ডাক বিভাগের সেবা হিসেবে প্রচার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর মালিকানায় ডাক বিভাগ ছিল না। বর্তমানে নগদের পরিচালনা পর্ষদে নয়জন সদস্য রয়েছেন, যাদের মধ্যে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিরা আছেন। এছাড়া ছয়জন বাংলাদেশি পরিচালক রয়েছেন। নগদের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার নিয়াজ মোর্শেদ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

২০১৮ সালের ৮ আগস্ট, সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের সময়ে, বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে “নগদ” নামে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়। তবে শর্ত মেনে আবেদন না করায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়নি। এরপর ডাক অধিদপ্তর নিজেদের আইনে পরিবর্তন এনে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ “নগদ” নামে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে, যার উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চালু হওয়ার পর নগদ আগ্রাসী কার্যক্রম শুরু করে এবং এর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব অভিযোগ আমলে নেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যাংকিং কার্যক্রম চালানোর সুযোগ নেই, যা নগদকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলে।

পরবর্তীতে নগদের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয় এবং সরকারি ভাতা বিতরণের দায়িত্ব পায়। এ অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় নগদকে লাইসেন্স দিতে সরাসরি সাবেক গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। এরপর, শর্ত পূরণ না করলেও, ২০২০ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক নগদকে সাময়িক অনুমোদন দিয়ে ডাক বিভাগকে চিঠি পাঠায়।

নগদে যখন অনিয়ম ঘটে, তখন এর পরিচালনায় ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী নেতা। সেই সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদার। সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় নগদ বিভিন্ন অনিয়ম করেছে, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীরবে তা পর্যবেক্ষণ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবকিছু জানার পরও নীরব ছিলেন, কারণ এর সঙ্গে তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। ডাক বিভাগও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।শেষ পর্যন্ত, ২১ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদে প্রশাসক নিয়োগ করে। প্রশাসক দায়িত্ব নেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত শুরু হলে একের পর এক চাঞ্চল্যকর জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ্যে আসে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!