বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ভার্চুয়াল মুদ্রা জব্দের দাবি করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিপ্টো লেনদেন প্ল্যাটফর্ম ওকেএক্স প্রায় ৩.৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ইউএসডিটি (ব্লকচেইনভিত্তিক স্থিতিশীল মুদ্রা) জব্দ করেছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৫ কোটি টাকা।
সিআইডির তথ্য অনুযায়ী, এই মুদ্রা মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের অংশ। তবে দেশে এ সংক্রান্ত কোনো স্পষ্ট আইন না থাকায় এবং এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা জটিলতার কারণে এই অর্থ ফেরত আনা কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, এমটিএফইর বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রতারণার মাধ্যমে ২০২৩ সালের আগস্টে দেশ থেকে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ ওঠে এমটিএফইর বিরুদ্ধে। এরপর ভুক্তভোগীদের মামলা ও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার (সিপিসি), ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), সাইবার ক্রাইম ইউনিট ও কাউন্টার টেররিজম ইউনিটসহ (সিটিটিসি) পুলিশের কয়েকটি ইউনিট। এর পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ম্যানুয়াল মুদ্রায় রূপান্তর করা আমেরিকান প্রতিষ্ঠান ওকেএক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করে এমটিএফইর ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে জানতে পারে সিপিসি। এরপর ওকেএক্সের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড মেনে এবং বাংলাদেশের আদালতের অনুমতি নিয়ে আবেদন করা হয়। এরপর সম্প্রতি ওকেএক্সে থাকা এমটিএফইর ভার্চুয়াল মুদ্রা জব্দ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস।
সিপিসির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আতিকুর রহমান এই ভার্চুয়াল কারেন্সি জব্দের কথা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, এমটিএফই প্রতারণার মাধ্যমে গ্রাহকের টাকা নিয়ে তা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে রূপান্তর করেছে। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে আইন না থাকলেও দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর স্বার্থে আমরা তৎপর ছিলাম। যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সহযোগিতায় ওকেএক্স প্লাটফর্মে আবেদনের পর প্রায় ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার জব্দ করতে পেরেছি। আইনি মীমাংসা হলেই এই অর্থ ফেরত আসতে পারে দেশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বিএম মইনুল হোসেন জানিয়েছেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হলেও এর অর্থ ফেরত আনা নিশ্চিত নয়। কারণ, ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ প্ল্যাটফর্মগুলো অবৈধ লেনদেন বা মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ পেলে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে রাখে, তবে পুরোপুরি নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণ ছাড়া অর্থ হস্তান্তর করে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পাচারকারীদের পরিচয় শনাক্ত করা এবং কোন নির্দিষ্ট আইনের আওতায় এই অর্থ অবৈধ হয়েছে তা স্পষ্ট করা। পাশাপাশি, এই অর্থ ফেরত পাওয়া অনেকাংশে নির্ভর করবে এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার ওপর। যেহেতু এসব প্ল্যাটফর্ম সাধারণত তাদের গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় অগ্রাধিকার দেয়, তাই অর্থ ফেরানোর বিষয়টি অনিশ্চিত রয়ে গেছে।
২০২৩ সালের আগস্টে আনুমানিক ১ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা) নিয়ে গায়েব হয় এমটিএফই। বাংলাদেশ থেকে এ প্রতিষ্ঠানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারী ছিল, এবং এই ১ বিলিয়ন ডলারের প্রায় ৯০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের। দুবাইভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) পঞ্জি মডেলে ব্যবসা চালাত। তারা বলেছিল, কিছু টাকা বিনিয়োগ করলে সহজেই প্রতিষ্ঠানটির সিইও হওয়া যাবে এবং প্রতিদিন মিলবে দ্বিগুণ-তিন গুণ মুনাফা, এজন্য বিদেশি অ্যাপে ট্রেডিং করতে হবে। এ আশায় লাখ লাখ টাকা লগ্নি করেছিলেন অগণিত মানুষ।
এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা মাসুদ আল ইসলাম বর্তমানে বিদেশে পলাতক। বড় এই আর্থিক প্রতারণার ঘটনায় ২০২৩ সালের ২৩ জুলাই রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়, এবং ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত এই মামলার কোনো অগ্রগতির খবর জানা যায়নি, এবং তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন রাজপাড়া থানার এসআই শাহ আলম।
দ্রুত অধিক লাভের আশায় এমটিএফইতে বিনিয়োগ করেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের মো. মারুফ রহমান মাহিম। তিনি বলেন, বিদেশে পলাতক এমটিএফইর অ্যাম্বাসেডর মুবাশসিরুল ইবাদের সঙ্গে পারিবারিকভাবে পরিচয় ছিল। তার মাধ্যমে এমটিএফইতে আমি ও পরিবারের সদস্যরা প্রায় এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করে প্রতারিত হই। এ ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলা করি। এরপর মামলাটির তদন্ত সিআইডিতে যায়। তবে এখনো টাকা উদ্ধারের বিষয়ে কিছু জানায়নি তারা।
তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম বলেন, মামলার বাদি যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল তারাও কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়েছে। তারা গ্রাহক পর্যায় থেকে টাকা নিয়ে চক্রের উপরের সারির কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিয়েছে। তারপর তাদের মাধ্যমে টাকা পাচার হয়েছে। তদন্ত শেষে এর প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা যাবে।