বাংলাদেশে ধনীদের তালিকা প্রকাশ করা হয় না, কারণ এখানে ধনীদের সম্পদের পরিমাণ এবং তাঁদের কতটা সম্পদ ভোগ করছেন, এসবের সঠিক তথ্য জানা কঠিন। এছাড়াও, তাদের সম্পদ বাড়ছে না কমছে, এমন তথ্যেরও স্বচ্ছতা নেই। মূলত, বড় বড় ধনীরা তাঁদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করতে আগ্রহী নন, ফলে তাঁদের সম্পদের পরিবর্তন সম্পর্কিত দৈনন্দিন হিসাব পাওয়া যায় না। এমনকি সম্পদ বিক্রি বা কেনার বিষয়েও কোনো তথ্য প্রকাশ্যে আসে না।
যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ধনীদের এ ধরনের তালিকা করা হয়। তা গণমাধ্যমেও আসে। বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকা প্রকাশের জন্য বিখ্যাত ফোর্বস সাময়িকী। সেখানে প্রতিনিয়তই ধনীদের হালনাগাদ অবস্থান দেখানো হয়। এ ছাড়া বিশ্বের বড় বড় শেয়ারবাজারের দরদামের ভিত্তিতেও ধনীদের সম্পদমূল্যের ওঠানামা করে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কখনো হয়নি। ফলে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের টপকে পুরোনো ঢাকার জর্দা ব্যবসায়ী প্রয়াত কাউছ মিয়া দেশের সেরা করদাতার সম্মাননা পেয়ে এসেছেন। এ ছাড়া কোনো সরকারের আমলেই আলাদা করে ধনীদের তালিকা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাতভিত্তিক সেরা করদাতাদের সম্মাননা ও কর কার্ড দিয়ে থাকে। এ বছর অবশ্য সেরা করদাতাদের সম্মাননা দেয়নি।
শেয়ারবাজারে অন্তর্ভুক্ত নয়
এ দেশের বড় ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় না। ফলে কোম্পানি মালিকেরা কী পরিমাণ অর্থ লভ্যাংশ পান, তা প্রকাশ্যে ঘোষণায় আসে না। ফলে তাঁদের আয় বা সম্পদের পরিমাণ জানা কঠিন হয়।বড় বড় দেশীয় কোম্পানিগুলো যদি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতো, তাহলে সেগুলোর মালিক বা কোম্পানি পরিচালকদের সম্পদের পরিমাণ জানা যেত। কে কত টাকার মালিক তা–ও প্রকাশ্যে আসত।
বাড়ি-গাড়ি কোম্পানির নামে
এ দেশের বড় কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা পরিচালকদের অনেকে কর ফাঁকি দিতে নিজেদের বাড়ি-গাড়ি নিজেদের নামে দেখান না। তাঁদের বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট—সবই প্রতিষ্ঠানের নামে থাকে। প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালক বা বড় পদধারী হওয়ায় তাঁরা এসব সম্পদ ভোগ করেন বলে কাগজে-কলমে দেখানো হয়। এমনকি স্ত্রী-সন্তানের জন্য ব্যবহার করা গাড়িও প্রতিষ্ঠান দেয়। কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠানই এসব সম্পদ ব্যবহারের সুবিধা দেয়। ফলে ওই ধনী ব্যবসায়ীর কর নথিতে এসব সম্পদ দেখানো হয় না। এমনকি জীবনযাত্রার বিভিন্ন খাতের খরচও প্রতিষ্ঠান বহন করে। ফলে এই ব্যক্তির টাকাপয়সা বা সম্পদ কত তা জানা যায় না।
সম্পদ গোপন রাখার প্রবণতা
এ দেশে সম্পদ লুকিয়ে রাখেন একশ্রেণির মানুষ। কারণ, ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট কেনেন; কিন্তু কর নথিতে আয়ের উৎস দেখাতে পারেন না তাঁরা। তাই স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়স্বজনের নামে এসব সম্পদ দেখানো হয়। তাই বিলাসবহুল জীবনযাপন করলেও এই শ্রেণিকে কখনোই ধনীদের কাতারে রাখতে পারেন না কর কর্মকর্তারা। ফলে আড়ালেই থাকেন তাঁরা; কিন্তু বিলাসী জীবন উপভোগ করে যান।
সম্পদমূল্যের ভুয়া ঘোষণা
এ দেশে সম্পদের সঠিক মূল্যায়ন হয় না। জমি-ফ্ল্যাট কেনাবেচার সময় প্রকৃত মূল্য ঘোষণা দেন না ক্রেতা–বিক্রেতা কেউ। এ ছাড়া নির্ধারিত মৌজা মূল্যেই জমি কেনাবেচা হয়। বাজারমূল্যের চেয়ে মৌজা মূল্য অনেক কম থাকে। ফলে বাড়তি টাকার লেনদেনের হিসাব থাকে না। যা কালোটাকা হয়ে যায় এবং কর নথিতে দেখানো হয় না।এ ছাড়া কর নথিতে প্রতিবছর সম্পদের মূল্য কেনা দামকে দেখানো হয়। যেমন কোনো করদাতা সত্তরের দশকে যদি এক লাখ টাকায় জমি কেনেন, এখনো কর নথিতে ওই জমির দাম এক লাখ টাকাই থাকবে। অথচ সেই জমির বাজারমূল্য এখন এক কোটি টাকা হয়ে গেছে; কিন্তু কর নথিতে ওই করদাতা মাত্র এক লাখ টাকার সম্পদের মালিক। এভাবে সম্পদের বাজারমূল্য বিবেচনায় না আনায় ধনীদের চিহ্নিত করার অন্যতম প্রধান সমস্যা।
এনবিআরের দক্ষতার অভাব
কোন করদাতা কত সম্পদের মালিক, কিংবা কার কত আয়-তা প্রকৃত অর্থে খুঁজে বের করার সক্ষমতাও কম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। বর্তমানে ১ কোটি ১০ লাখের বেশি কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) আছেন। তাঁদের মধ্যে ৪০ লাখের বেশি প্রতিবছর রিটার্ন জমা দেন। কিন্তু এনবিআরের আয়কর বিভাগের সীমিত জনবল দিয়ে বিশালসংখ্যক রিটার্ন দেওয়া করদাতাদের কর নথি পর্যালোচনা করা কঠিন। ফলে এনবিআরের আয়কর বিভাগ যারা নিয়মিত করদাতা, তাঁদের কাছেই বেশি যায়।
সারচার্জ প্রদান করেন মাত্র ১৫ হাজার করদাতা
বর্তমানে চার কোটি টাকার বেশি সম্পদধারীর প্রদত্ত আয়করের ওপর সারচার্জ দিতে হয়। এনবিআরের সর্বশেষ হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মাত্র ১৪ হাজার ৮৫৪ জন করদাতা সারচার্জ দিয়েছেন। এতে এনবিআরের প্রাপ্তি মাত্র ৬২৬ কোটি টাকা। তখন অবশ্য তিন কোটি টাকার বেশি সম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হতো। এনবিআরের ভাষায়, সারচার্জ দেওয়া করদাতারাই দেশের অতিধনী। সেই হিসাবে, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে সারচার্জ দেওয়া ‘অতিধনী’ করদাতার সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়ায়নি।