দেশের ৫৩ শতাংশ পরিবারে দীর্ঘমেয়াদি রোগী

পিপিআরসির গবেষণা

দেশে দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত মানুষের হার ক্রমেই বাড়ছে। প্রতি বছর মৃত্যুর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ঘটছে এসব রোগের কারণে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৫৩ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। বড় ধরনের এই রোগের চিকিৎসা রোগীর নিজের ব্যয় বাড়াচ্ছে, যা বিশেষজ্ঞরা আউট-অফ-পকেট এক্সপেনডিচার (ওওপি) বলে অভিহিত করছেন। এর ফলে জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় দেশের দীর্ঘমেয়াদি রোগের পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। ‘ইকোনমিক ডায়নামিকস অ্যান্ড মুড অ্যাট হাউসহোল্ড লেভেল ইন মিড ২০২৫’ শীর্ষক এই গবেষণাটি ৮ হাজার ৬৭টি পরিবারের ৩৩ হাজার ২০৭ জন সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ পরিবারের অন্তত একজন দীর্ঘমেয়াদি রোগে (ক্রনিক ডিজিজ) আক্রান্ত রোগী রয়েছেন। কোনো কোনো পরিবারে একাধিক সদস্য এ ধরনের রোগে ভুগছেন। সবচেয়ে বেশি লোক যে দীর্ঘমেয়াদি অসুখে আক্রান্ত, তা হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ। ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবারের সদস্য এ রোগে ভুগছেন। সংখ্যার হিসাবে এর পরে রয়েছে যথাক্রমে গ্যাস্ট্রিক আলসার (২৬ দশমিক ৫ শতাংশ), ডায়াবেটিস (২৩ শতাংশ), হৃদ্‌রোগ বা হৃদ্‌রোগের জটিলতা (১৫ দশমিক ৭ শতাংশ), চর্মরোগ বা অ্যালার্জি (১১ দশমিক ২ শতাংশ), অ্যাজমা (১০ দশমিক ৪ শতাংশ), হাড়ের সমস্যা অস্টিওপোরোসিস বা ক্যালসিয়াম ঘাটতির রোগ (৯ দশমিক ৭ শতাংশ) চোখের সমস্যা (৭ শতাংশ), বাত বা আর্থ্রাইটিস (৪ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ (৪ দশমিক ৮ শতাংশ)।

পিপিআরসি বলছে, দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রভাব শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির দুর্ভোগেই সীমাবদ্ধ নয়। এর চিকিৎসার ব্যয় পরিবার ও রাষ্ট্রের ওপরও প্রভাব ফেলে। দীর্ঘমেয়াদি রোগের বোঝা এবং তার আর্থিক প্রভাব একটি সাধারণ সমস্যা হিসেবে ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়। এটি ধনী বা গরিব, শহর বা গ্রামের মানুষ নির্বিশেষে সব শ্রেণির জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই স্বাস্থ্যনীতি ও সেবা পরিকল্পনায় এর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) অনুযায়ী, যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা এক বছর বা তার বেশি সময় স্থায়ী থাকে এবং যার জন্য নিয়মিত চিকিৎসার প্রয়োজন হয় বা যা দৈনন্দিন কাজকর্ম সীমিত করতে পারে—সেগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বাতের মতো সাধারণ রোগের পাশাপাশি ক্যানসার ও কিডনির অসুখও এর অন্তর্ভুক্ত। ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা এবং মদপান—এই চারটি ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাসের কারণে অনেক দীর্ঘমেয়াদি রোগ সৃষ্টি হয়, যা প্রতিরোধযোগ্য।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) অনুযায়ী, দীর্ঘমেয়াদি রোগের মধ্যে অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) এবং সংক্রামক রোগ—দুই ধরনের অসুখই রয়েছে। এর মধ্যে এনসিডি রোগগুলো সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী এবং ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়। ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে মৃত্যুর প্রধান কারণ হৃদ্‌রোগ বা ক্যানসারের মতো এনসিডি।

পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে কত শতাংশ পরিবারে দীর্ঘমেয়াদি অসুখের রোগী রয়েছেন তা আগে জানা যায়নি। পিপিআরসির গবেষণায় প্রথমবারের মতো দেখা গেছে, দেশের ৫০ শতাংশের বেশি পরিবারে এমন রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছে। নিয়মিত ওষুধ ও সার্বিক চিকিৎসার খরচ অধিকাংশ পরিবারের ওপর বড় ধরনের আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে, যা কমানোর জন্য কার্যকর কোনো সহায়তা নেই। তিনি বলেন, সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য ওষুধের খরচ কমাতে নতুন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বিবেচনা করা উচিত। এছাড়া এসব রোগ প্রতিরোধযোগ্য হওয়ায় যথাযথ প্রতিরোধ কার্যক্রম গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্যের এ বড় সমস্যা কমানোর জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার ও জীবনযাত্রার ধরন—এসবও এই ধরনের রোগ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। গত বছরের জুনে প্রকাশিত ‘হেলথ বুলেটিন ২০২৩’-এ বলা হয়েছে, দেশ ধীরে ধীরে সংক্রামক রোগ থেকে অসংক্রামক রোগের দিকে চলে যাচ্ছে। অসুস্থতা ও মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে অসংক্রামক রোগ প্রধান হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ক্যানসার এবং দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ ব্যাপকভাবে দেখা যাচ্ছে। দেশে মোট মৃত্যুর ৭০.২৬ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে ঘটে, যার মধ্যে হৃদরোগে ৩৪ শতাংশ, ক্যানসারে ১০ শতাংশ, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগে ৭ শতাংশ, ডায়াবেটিসে ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগে ১১ শতাংশ মৃত্যুর হার। অন্যদিকে সংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার ২৩ শতাংশ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শাফিউন নাহিন শিমুল বলেন, দীর্ঘমেয়াদি রোগ দেশের সামগ্রিক দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রভাব ফেলছে। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি রোগও বাড়ছে। যদি সরকারিভাবে সময়মতো যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া যায়, তাহলে এসব রোগ মারাত্মক হয়ে উঠবে না এবং চিকিৎসা ব্যয়ও কম থাকবে।

ডব্লিউএইচওর পরিভাষা অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য ব্যক্তি বা পরিবার যে অর্থ নিজের পকেট থেকে খরচ করে, তাকে ‘আউট-অব-পকেট’ (ওওপি) ব্যয় বলা হয়। ওওপির হার বেশি হলে তা দারিদ্র্য ও আর্থিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। কারণ এটি অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যাঘাত ঘটায়। ওওপি ৪০ শতাংশের বেশি হলে তাকে বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য ব্যয় বলা হয়। উচ্চ ওওপি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরও চাপ সৃষ্টি করে।

সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট জানিয়েছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (ওওপি) ৬৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী এটি ৭৪ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসার উচ্চ ব্যয়ের কারণে দেশের ১৮ শতাংশ পরিবার বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ২০২২ সালে এ কারণে দেশে ৬১ লাখের বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!