নিম্নস্তরে দাম-শুল্ক বাড়ানো, ষড়যন্ত্র দেখছে দেশীয় কোম্পানি

ষড়যন্ত্রে জড়িত বহুজাতিক কোম্পানি

** মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চস্তরে সম্পূরক শুল্ক ২% বাড়ানো হলেও নিম্নস্তরে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে ১২%
** নিম্নস্তরে দাম বেড়েছে ২০%, অথচ মধ্যমস্তরে ১৪%, উচ্চস্তরে ১৭% ও অতি উচ্চস্তরে বেড়েছে ১৬%
** নিম্নস্তরের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পেছনে বহুজাতিক কোম্পানির ষড়যন্ত্র দেখছে দেশীয় কোম্পানি

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নিম্নস্তরের সিগারেটের সবচেয়ে বেশি দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। যেখানে মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম বেড়েছে ৪ থেকে ৭ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। সেখানে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বেড়েছে এক লাফে ১১ শতাংশ, আর সম্পূরক শুল্ক বেড়েছে ৩ শতাংশ। যার ফলে দেশীয় সিগারেট শিল্প ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বাজেটের বাজেটের মাঝামাঝি এসে আবার সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়। এবারও একই কাহিনী। মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চস্তরের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ। আর সম্পূরক শুল্ক বোড়ানো হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। অথচ নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে এক লাফে ২০ শতাংশ, আর সম্পূরক শুল্ক ১২ শতাংশ। দেশীয় সিগারেট শিল্প বা দেশীয় সিগারেট কোম্পানিগুলো সাধারণত নিম্নস্তরের সিগারেট উৎপাদন ও বাজারজাত করে।

তাদের অভিযোগ, দেশীয় সিগারেট শিল্পকে ধ্বংস করার নীলনকশা বাস্তবায়ন করছে একটি বহুজাতিক কোম্পানি। তারা উচ্চস্তরের সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক তেমন বাড়াতে দেয়নি। অথচ প্রভাব খাটিয়ে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক সর্বোচ্চ বাড়ানো হয়েছে। যাতে করে দেশীয় কোম্পানি ধ্বংস হয়ে যায়। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বৈষম্যমূলক কর বৃদ্ধির ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যাবে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোতে ষড়যন্ত্র দেখছেন দেশীয় সিগারেট কোম্পানির মালিকরা। গতকাল রোববার রাজধানীতে একটি হোটেলে ন্যাশনাল সিগারেট ম্যানুফেকচারার অ্যাসোসিয়েশনের (এনসিএমএ) সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিউটি টোব্যাকোর সত্ত্বাধিকারী নাজমুন নাহার লাকি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্বৈরাচারি মনোভাব, মনোপলি বাণিজ্য নীতি ও সরকারি আমলাদের একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য শতভাগ দেশীয় কোম্পানিগুলো রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হচ্ছে। নিম্নস্তরে বিদেশি ব্রান্ড অনুমোদন করা হবে না ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নেয়া এই সিদ্ধান্তটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দোসর বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসন ও চক্রান্তের জন্য ব্যাহত হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, গত ১০ বছর আগে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো যেখানে ২০০ কোটি টাকা মুনাফা করতো, এখন তা দুই হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিদেশি মালিকানাধীন শেয়ারের লভ্যাংশের অংশ হিসেবে এক হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোর মুনাফা দেশেই থাকছে। দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে। গত ১০ বছরে বিদেশি কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্যের কারণে দেশীয় কোম্পানিগুলো সর্বস্বান্ত হয়ে ব্যবসা বন্ধের দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে।

দেশীয় কোম্পানিগুলোর পক্ষ ২০২৩-২৪, ২০২৪-২৫ অর্থবছর ও সম্প্রতি অধ্যাদেশের মাধ্যমে সিগারেট খাতের মূল্য ও সম্পূরক শুল্ক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর (বাজেট ঘোষণা ২১ জুন) সিগারেটের চারটি স্তরের মধ্যে তিনটি স্তরের সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো না হলেও নিম্নস্তরের সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর অতি উচ্চ স্তরের দাম ৬ শতাংশ, উচ্চস্তরের ২ শতাংশ ও মধ্যম স্তরের দাম ৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে এক লাফে ১৩ শতাংশ। মূলত একটি বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানির প্ররোচনা ও প্রভাবে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্কে খড়গ নেমে আসে। একইভাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছর (বাজেট ঘোষণা ৬ জুন) চারটি স্তরের মধ্যে উপরের তিনটি স্তরের সম্পূরক শুল্ক ১ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিম্নস্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয় ৩ শতাংশ। দামের ক্ষেত্রেও একই ফর্মূলা প্রয়োগ করা হয়। অতি উচ্চস্তরে ৭ শতাংশ, উচ্চস্তরে ৬ শতাংশ ও মধ্যম স্তরে ৪ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে এক লাফে ১১ শতাংশ। দেশীয় সিগারেট কোম্পানিকে ধ্বংস করার বাকি রাখেনি। ধ্বংসের শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে ৯ জানুয়ারি অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে আবার সিগারেটসহ বেশ কিছু পণ্যের ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির মাধ্যমে। এখানেও সেই বহুজাতিক কোম্পানির নীলনকশা বাস্তবায়িত হয়েছে বলে দেশীয় কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা অভিযোগ করেছেন।

দেশীয় সিগারেট কোম্পানির অভিযোগ, ৯ জানুয়ারি অধ্যাদেশের মাধ্যমে চারটি সিগারেট স্তরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০ শতাংশ হারে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ অতি উচ্চস্তরে ১৬ শতাংশ, উচ্চস্তরে ১৭ শতাংশ ও মধ্যম স্তরে ১৪ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। শুধু দাম নয়, নিম্নস্তরের সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক এক লাফে ১২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যেখানে অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যম স্তরে মাত্র ২ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কোম্পানিগুলোর অভিযোগ, নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে বহুজাতিক কোম্পানি বিশেষ করে বিএটি বাংলাদেশের লাভ। এই কোম্পানি অতি উচ্চ, উচ্চ ও মধ্যম স্তরের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ নিম্নস্তরের সিগারেট উৎপাদন করে। নিম্নস্তরের সিগারেট বাজারের প্রায় ৮৫ শতাংশ এই কোম্পানির দখলে। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো একমাত্র নিম্নস্তরের সিগারেট উৎপাদন করে। ফলে নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলেও বিএটির ক্ষতি হবে না। কারণ তারা বাকি তিনটি স্তরের সিগারেট দিয়ে কাভার করতে পারে। অথচ নিম্নস্তরের সিগারেটের সর্বোচ্চ দাম ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ফলে দেশীয় কোম্পানিগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে। এটি চরম বৈষম্য ও আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের শামিল। এ শিল্পের সাথে চাষী, কারখানা শ্রমিক, বিপণন কর্মীসহ ১০ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। নজিরবিহীন বৈষম্যমূলক করনীতির কারণে দেশীয় শিল্পের ধ্বংস হয়ে যাবে।

অপরদিকে, দেশীয় সিগারেট কোম্পানির একাধিক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানিয়েছেন, এনবিআর চারটি স্তরের মধ্যে নিম্নস্তর ছাড়া বাকি তিনটি স্তরের সিগারেটের দাম ও শুল্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়। পরে কিন্তু একটি বহুজাতিক কোম্পানির কূটকৌশলের কারণে নিম্নস্তরের সিগারেটে এই বিপুল পরিমাণ দাম ও কর বসাতে এনবিআর বাধ্য হয়। নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ও শুল্ক বাড়ানো হলে দেশীয় কোম্পানিগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে—এই নীলনকশা বাস্তবায়নে ওই বহুজাতিক কোম্পানি অনেক টাকা ঢেলেছেন বলেও আমরা জানতে পেরেছি। তারা আরো বলেন, বহুজাতিক এই কোম্পানি দেশীয় সিগারেট শিল্পকে ধ্বংস করে নিম্নস্তরের সিগারেটের বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশ দখল করেছেন। প্রভাব খাটিয়ে, মোটা অংকের টাকা ব্যয় করে সিগারেটের কর ব্যবস্থা পরিবর্তন করে দিয়েছেন। যার ফলে দেশীয় সিগারেট খাত বা শিল্প ধ্বংস হয়ে গেছে। দেশীয় কোম্পানির সিগারেট মার্কেটে নেই বললেই চলে। অনেক কোম্পানি ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। কেউ কেউ ব্যবস্থা পরিবর্তন করেছে, আবার কেউ নামমাত্র ব্যবসা করছে। বহুজাতিক এই কোম্পানিটি বাজার দখল করে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। আবার দেশ থেকে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশীয় কোম্পানিগুলো আয় করে দেশেই বিনিয়োগ করে।

সংবাদ সম্মেলনে হেরিটেজ টোব্যাকোর মো. আরিফ আলম, বিউটি টোবাকোর নাজমুন নাহার লাকি, এবি টোব্যাকোর আব্দুল কাদের, যমুনা টোব্যাকোর মোস্তাফিজার রহমান সাদা, মেঘনা টোব্যাকোর মো. রফিকুল আলম, ফরিদপুর টোব্যাকোর মো. আকরাম, সাউথ বাংলা টোব্যাকোর সোমনাথ দে, ক্লাসিক টোব্যাকোর তুহিন, এএলএম টোব্যাকোর শাহরিয়ার আরমান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আকিজ টোব্যাকো, আবুল খায়ের টোব্যাকো, তিতাস টোব্যাকো, ভারগন টোব্যাকো, এসএম টোব্যাকো ও রয়েল টোব্যাকোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!