মো. আবদুর রহমান খান এফসিএমএ গত ১৪ আগস্ট অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে তিনি অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব ছিলেন। বিসিএস (কর) ১৩ ব্যাচের এই কর্মকর্তা এনবিআরে যোগ দেয়ার পর থেকে এই দপ্তরকে ঢেলে সাজানো, দুর্নীতি ও হয়রানিমুক্ত করা, করফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধ, করনেট বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। সম্প্রতি শেয়ার বিজের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। সাক্ষাতকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার রহমান রহমান।
বিজনেস বার্তা: করদাতাদের প্রচুর অভিযোগ থাকে। কিন্তু কোথায় গিয়ে কিভাবে অভিযোগ করতে হবে, প্রতিকার পাবেন কি না—এই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। অভিযোগ প্রতিকারের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা? এনবিআরে সুশাসন আনার ক্ষেত্রে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবেন?
মো. আবদুর রহমান খান: আমাদের করদাতাদের প্রচুর অভিযোগ রয়েছে, তারা এগুলো আমাদের কাছে জানাতে পারেন না। আমাদের সুন্দর একটি জিআরএস (গ্রিভেন্স রিড্রেস সিস্টেম বা অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা) পদ্ধতি রয়েছে। সম্পূর্ণ অটোমেটেড এই পদ্ধতি। আমাদের করদাতা, ব্যবসায়ীদের অ্যাসোসিয়েশন এটা সম্পর্কে জানেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই জিআরএস পদ্ধতি ব্যবহার করে কিভাবে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ থেকে কিভাবে অভিযোগ করবে—তা আমরা প্রচার করবো। জিআরএস সিস্টেমে কোনো করদাতা বা ব্যক্তি অভিযোগ করার সঙ্গে সঙ্গে—সেই অভিযোগ সরাসরি অনলাইনে আমার কাছে চলে আসবে। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওই অভিযোগকে অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করবো। যদি বড় ধরনের অভিযোগ থাকে—সেগুলো যাচাই-বাচাই করে যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে যারা এই কাজগুলো করবেন, তাদেরকে আমরা বিচারের আওতায় নিয়ে আসবো। অত্যন্ত কঠিন বিধি বিধান আমরা প্রয়োগ করবো। আমি সব চেম্বার, অ্যাসোসিয়েশন, বিজনেস কমিউনিটিকে বলবো—আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কেউ যদি অপেশাদার আচরণ করেন আপনারা জিআরএস সিস্টেমে আমাদেরকে আপনাদের অভিযোগ জানান। কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলবো—আমরা অত্যন্ত ট্যালেন্টেড পিপল। আমরা কম্পিটেটিভ পরীক্ষা দিয়ে আসছি। আমাদের ক্যাপাসিটি আছে। দেশটা আমাদের। আমাদের নতুন প্রজন্ম আমাদেরকে যে বিশাল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে—এই সুযোগ বারবার আসবে না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমরা বৈষম্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। এই বাংলাদেশ গড়া একা একা হবে না। আমি বিজনেস কমিউনিটিকে বলেছি, আপনারা বেশি বেশি ট্যাক্স দেন। ট্যাক্সের অতিরিক্ত কোনো টাকা খরচ করা লাগবে না। যখন অতিরিক্ত খরচ কমে যাবে, অটোমেটিক্যালি তারা বেশি বেশি ট্যাক্স সরকারি কোষাগারে দেবেন। একটা জনশ্রুতি আছে যে, আমরা যা রাজস্ব আদায় করি। বিজনেস কমিউনিটিকে তার কয়েকগুণ অন্যদিকে খরচ করতে হয়। আমরা যদি এটাকে অ্যাড্রেস করতে পারি, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতে পারি। যারা ভালো কাজ করবেন—তাদের অ্যাপ্রিশিয়েট করবো এবং যারা খারাপ কাজ করবেন—তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা। আমি ট্যাক্সপেয়ার ও বিজনেস কমিউনিটিকে বলবো—আপনাদের কমপ্লেন আমাদের জানান। আমরা কুইক একশন নেবো। আমরা যদি ন্যূনতম প্রমাণ পাই—আমরা সে ব্যাপারে ক্লিয়ার অ্যাকশন নেবো। তাহলে তা কমে যাবে।
বিজনেস বার্তা: সব জায়গায় শুদ্ধি অভিযান হচ্ছে। এনবিআর ও এনবিআরের মাঠ পর্যায়ে শুদ্ধি অভিযান করার উদ্যোগ নেবেন কি?
আবদুর রহমান খান: আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি এবং জিআরএস সিস্টেম দেখিয়ে দিয়েছি। আপনারা আমার কাছে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে আপনাদের মতামত, অভিজ্ঞতা, অভিযোগ, ভোগান্তি—আমাদের অফিসাররা কি ধরনের ডিলিং করেন—সেই ধরনের তথ্য প্রমাণসহ আমার কাছে জানাতে পারেন। আমি কুইক অ্যাকশন নেব। আমার তরফ থেকে এটাই আমার শুদ্ধি অভিযান। আরেকটা হলো—সরকারের পক্ষ থেকে যে অভিযান করা হবে। আরেকটা হলো—বড় ব্যবসায়ী যারা কম ট্যাক্স দিচ্ছেন—তাদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে শুদ্ধি অভিযান করা হবে।
বিজনেস বার্তা: অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানো খুবই জরুরি। বাজেটে যে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়, তা কোনো বছরই আহরণ সম্ভব হয় না। বর্তমানে দেশে আর্থিক টানাপোড়ন আছে। আপনি কিভাবে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াবেন?
আবদুর রহমান খান: অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের কোনো বিকল্প নেই। আমরা বিভিন্ন ইন্ডিকেটরে, বিশেষ করে করদাতার সংখ্যা, নিবন্ধিত করদাতা যারা রয়েছেন-তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ট্যাক্স রিটার্ন সাবমিট না করা এবং ট্যাক্স নেটকে বড় করা। আমাদের মোট জন সংখ্যার মাত্র ৫ দশমিক ২ শতাংশ ট্যাক্স নিবন্ধিত। অথচ আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে পার্সেন্টেজ ২৩-এর ওপরে। সুতরাং আমাদের অনেক নতুন করদাতা আনার সুযোগ রয়েছে। আবার যারা নিয়মিত করদাতা নিবন্ধিত হচ্ছেন, কিন্তু তাদের থেকে ট্যাক্স রিটার্ন ও ট্যাক্স পাচ্ছি কিনা-এই মনিটরিংটা অত্যন্ত দুর্বল। আমরা এই কাজগুলো শুরু করবো। প্রথমে ম্যানুয়ালি এবং দ্রুত সময়ে আমরা ডিজিটাইজেশনে যাবো। বিশেষ করে ট্যাক্স যেখান থেকে ফাঁকি হয় বা বড় বড় যেখান থেকে আমরা ট্যাক্স পাই না-সেখান থেকে ট্যাক্স আদায় করার চেষ্টা করবো। বেশ কিছু কর অব্যাহতি রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলি-মৎস্য আয়, পোল্ট্রি, ডেইরির আয়গুলো অনেকদিন কর অব্যাহতি ছিলো। এখন এখানে অল্প কিছু ট্যাক্স করা হয়েছে। আমরা খেয়াল করেছি, এগুলো ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার একটা বড় জায়গা। যেহেতু এখানে ট্যাক্স রেট কম। আপনি অন্য ব্যবসার পাশাপাশি যদি বলেন, আমার এখানে বড় ব্যবসা আছে। এমনকি আইসিটি খাতেও অনেক বছর ধরে কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যেখানে কর অব্যাহতি আছে, সেখানে আমরা দেখেছি করফাঁকি হচ্ছে।
আমাদের গ্রামে যে যুবক শ্রেণির শিক্ষিত বেকার যারা, যারা পোল্ট্রি চাষ করেন অথবা যারা ডেইরি ফার্ম করেন, মাছের চাষ করেন-সত্যিকার অর্থে তারা কিন্তু এই কর অব্যাহতির সুবিধা পান না। এসব যুবকদের খোঁজ খবর কেউ নেয় না। আমাদের ট্যাক্স অফিস ওই পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারেনি। অথচ এই যুবকরাই সত্যিকারের মৎস্য, পোল্ট্রি ও ডেইরি উৎপাদক। এদের জন্য আমরা কর অব্যাহতি দিলাম। বাস্তবে এই অব্যাহতি যারা ব্যবহার করেন, তারা ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার একটি কৌশল হিসেবে। আইসিটি খাতেও একই অবস্থা। দেখা গেলো, আইসিটি থেকে বিপুল পরিমাণ আয় হলো। কিন্তু দেখানো হয় লোকসান। এসব খাত আমরা ধীরে ধীরে চিহ্নিত করবো। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দ্রুত অটোমেশন করা। আমরা অল্প অল্প করে অটোমেশনে যাবো।
আমরা এখন কমপ্লায়েন্সের দিকে বেশি জোর দেব। যত আইন হয়েছে, সে আইনগুলো কারা মানছে, কারা মানছে না এবং না মানার যে কারণ সেগুলো আমরা দেখা শুরু করবো। আমাদের প্রত্যেক ট্যাক্স পেয়ারকে মনিটর করবো, তাদের সঙ্গে আমাদের নিবিড় যোগাযোগ থাকবে। আমরা তাদেরকে আস্থায় নিয়ে, কোন ট্যাক্সপেয়ার যাতে এটা মনে না করে যে ট্যাক্স অথরিটি আমার ওপর বল প্রয়োগ করছে। আমরা যে মেসেজ দিতে চাই-তাহলো, এই দেশটা আমাদের। এই দেশ পরিচালনার জন্য এবং আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুন্দর ও উন্নত জীবন দেয়ার জন্য, উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের যা রেভিনিউ দরকার তা আমাদের যোগান দিতে হবে। আমাদের যাদের আয় বেশি তাদেরকে দিতে হবে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা সুশাসন। আমাদের ট্যাক্স অথরিটিকে চিন্তা করতে হবে, আমি যাদেরকে নিয়ে ডিল করি তারা আমার ক্লায়েন্ট। আমার ক্লায়েন্টের ফুল সেটিসফ্যাকশন নিয়েই আমি তার কাছ থেকে ট্যাক্স নেব। রাজস্ব প্রশাসনের রোল এমন হওয়া উচিত যে, ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি না করে তাদেরকে গ্রো করতে দিয়ে ট্যাক্স আদায় করা। এমন ট্যাক্স আরোপ করবো না, যাতে ট্যাক্স পেয়ার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মৌমাছি যেভাবে ফুলের ক্ষতি না করে ফুল থেকে মধু আহরণ করেন, ঠিক তেমনি রেভিনিউ অফিসাররা ট্যাক্স পেয়ারকে সেভাবে দেখবেন। বারবার তাদের কাছ থেকে ট্যাক্স নেবে এবং তাদেরকে গ্রো করতে দেবে।
বিজনেস বার্তা: পাঁচটি বড় কোম্পানি ও তাদের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে করফাঁকির তদন্ত করা হচ্ছে। এ ধরনের অনেক বড় কোম্পানি ও তাদের কর্ণধাররা রয়েছেন। বড় করফাঁকিবাজদের কোনো তালিকা করা হয়েছে কি?
আবদুর রহমান খান: কর বিভাগের বড় কাজই হচ্ছে করফাঁকি খুঁজে বের করা। কিন্তু আমাদের ক্যাপাসিটি লিমিটেড। সারাবছর আমাদের কাজ করতে হয়। প্রায়োরিটি ঠিক করে হয়ত আগে পাঁচজনের তালিকা করা হয়েছে। তালিকা আমরা ধীরে ধীরে বড় করবো, সংখ্যা আরও বাড়বে। আমাদের ট্যাক্স লাগবে। সুতরাং দীর্ঘদিন ধরে যারা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছে—তাদেরকে ধরবো। আরেকটা মেসেজ হলো—আমাদের অডিট সিলেকশন নিয়ে অনেক কমপ্লেইন হয় যে, অডিট সিলেকশন প্রক্রিয়া ট্রান্সপারেন্ট না। আমাদের যখন ফুল অটোমেশন হয়ে যাবে। তখন সিস্টেম থেকে সিলেকশন হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, অডিট সিলেকশন সিস্টেম আপাতত ফুল অটোমেটেড করবো। ম্যানুয়ালি সিলেকশন আর হবে না। এ বছরই আমরা তা শুরু করবো। তালিকা তৈরির কাজ চলছে, সময় লাগবে; শতাধিক হবে।
***