বিগত ১৫ বছরে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছেন ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান। ওয়াসার বড় প্রকল্পে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি চিহ্নিত হলেও, শেখ হাসিনা কখনও নীরব থাকেননি; বরং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এমডি পদে তার মেয়াদ সাতবার বাড়িয়েছেন।
২০২৩ সালের আগস্টে ৭ম বারের মতো এমডি পদে আরও ৩ বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলেও দেশ ছাড়তে পারেননি তাকসিম। ভঙ্গুর ও ঋণগ্রস্ত ওয়াসাকে ফেলে অনলাইনে পদত্যাগ করে রীতিমতো আত্মগোপনে চলে যান তিনি। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতার অভিযোগ উঠেছে।
অর্থপাচার, নিয়োগ-বাণিজ্য, বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও অন্যান্য খাতে অন্তত ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ওয়াসার সাবেক এই এমডির বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি দুদকের উপ-পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে তাকসিম এ খানসহ বোর্ডের ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন।
মামলায় বলা হয়েছে, ওয়াসার সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম ও এ কে এম সহিদ উদ্দিনের নিয়োগ প্রস্তাবের সাথে একমত পোষণ করেন আসামিরা। পাশাপাশি তাদের বেতন-ভাতা বাবদ ১ কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৯৮০ টাকা আত্মসাতের
সহযোগিতা করেন। ওয়াসার সাবেক পরিচালক আবুল কাশেম অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যক্তিস্বার্থে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য পরস্পর যোগসাজশে অনিয়ম–দুর্নীতির মাধ্যমে পরিচালক (উন্নয়ন) পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে বেতন-ভাতাদি বাবদ ৯৯ লাখ ৫২ হাজার ২৭১ টাকা আত্মসাৎ করেন। অন্যদিকে, এ কে এম সহিদ উদ্দিনও বেতন-ভাতাদি বাবদ ৯৯ লাখ ৫২ হাজার ২৭১ টাকা আত্মসাৎ করেন।
দুদক সূত্রের দাবি, মামলা দায়েরের পর তদন্ত দল পরিবর্তন হলেও তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ওয়াসার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্ত কাজ বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতিবাজদের সেই চেষ্টা থাকতেই পারে। এরপরও এ সময়ে অভিযোগের তদন্ত হবে সঠিকভাবেই বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে, রাজধানীর মুগদায় আবদুল বাছেদ শামীম নামে এক আইনজীবীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাকসিম এ খানসহ ৫৯ জনের নামে মামলা হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের নেতারা সরকারকে লেখা এক চিঠিতে অভিযোগ করেন, পদ্মা (যশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের সঞ্চালন লাইন নির্মাণে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা। এছাড়া দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগারের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতি হয়েছে ৬০০ কোটি টাকা, পানি ও পয়ঃবিলের ৩ হাজার ২২১ কোটি টাকা, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ৬২১ কোটি টাকা ।তাদের অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিতাড়িত শেখ হাসিনার আত্মীয় বলে তিনি আইনকে পরোয়া না করে যা খুশি তাই করেছেন। অন্যায়ভাবে অনেককে চাকরিচ্যুত করেছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনার পরও স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে দেননি অনেককে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তাকসিম এ খান ঢাকা ওয়াসাকে একটি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। তার ক্ষমতা এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, দেশের আইন ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাও তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অভিযোগের পর অভিযোগ প্রমাণিত হলেও, শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় তিনি ওয়াসাকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। বিভিন্ন প্রকল্পের নামে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন এবং পূর্ববর্তী সরকারের সহায়তায় এসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। তার মেয়াদে শত শত কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও নগরবাসী কোনো সুফল পায়নি। বরং, পানি ও পয়ঃসেবা দাম বাড়িয়ে রাজধানী বাসীকে দুর্ভোগে ফেলেছেন। ২০০৯ সালের পর থেকে ১৬ বার ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়িয়েছেন তিনি। বৈদেশিক সহায়তা নির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে ওয়াসা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এমডি হিসেবে তার মাসিক বেতন ছিল ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা, এবং করোনা মহামারির সময়ে বেতন প্রায় দুই লাখ টাকা বাড়ানো হয়। ২০০৯ সালে তাকসিম যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে যোগ দেন। তার পরিবারের সব সদস্যই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। তাকসিমের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ১৪টি বাড়ি রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি বাড়ির তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে ৪১৯, ই সাইপ্রেস অ্যাভিনিউ, বারব্যাংক, সিএ ৯১৫০১ ঠিকানায় ১৯ লাখ ৭৬ হাজার ৮৮৯ ডলারে (প্রায় ১৭ কোটি টাকা) কেনা একটি বাড়িতে ১৪টি বেডরুম এবং ১৪টি বাথরুম রয়েছে। এছাড়া ২০১৮ সালে ৫১৮, সেলেম স্ট্রিট, গ্লেনডেল, সিএ ৯১২০৩ ঠিকানায় ৪৩ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৪ ডলারে (প্রায় ৩৭ কোটি টাকা) কেনা বাড়িতে ছয়টি বেডরুম এবং ছয়টি বাথরুম রয়েছে।
এছাড়া ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৩৫০ ই ৩০তম স্ট্রিট, নিউইয়র্ক, সিএ ১০০১৬-৮৩৮৬ ঠিকানায় ৬ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৬১৪ ডলারে (প্রায় ৫৩৫ কোটি টাকা) কেনা বাড়িতে ১০২টি বেডরুম ও ১০২টি বাথরুম রয়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে ৩৫৫৫ কাইসস্টোন অ্যাভিনিউ, লস অ্যাঞ্জেলস, সিএ ৯০০৩৪ ঠিকানায় ৮২ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮০ ডলারে (প্রায় ৭০ কোটি টাকা) কেনা আরেকটি বাড়িতে ১২টি বেডরুম ও ১২টি বাথরুম রয়েছে। এসব বাড়ি ভাড়া দিয়ে রেখেছেন তাকসিম। যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পদ থাকলেও দেশে কোনো সম্পত্তি নেই তাকসিমের। গুলশান-২ এর ৫৫ নম্বর সড়কে সরকারি বাসভবনে বসবাস না করে নয়াপল্টনে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন তাকসিম।