** পাচার করা টাকায় দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশি ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয় করেছে
** ৭০ জনের তালিকায় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, প্রকৌশলীর নাম রয়েছে
বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে। পাচার হয়েছে কখনো ব্যবসার আড়ালে, আবার কখনো সরাসরি। পাচারের তালিকায় ব্যবসায়ী, আমলা, ঠিকাদার, সরকারি চাকরিজীবী, রাজনীবিদ, প্রকৌশলী শুরু শুরু করে কে নেই! পাচারের এই অর্থ সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে জমা হয়েছে। বাংলাদেশিদের পাচার করা টাকা সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন দেশের ব্যাংক থেকে গেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা দুবাইয়ে। এসব টাকা দিয়ে দুবাইয়ে বিলাসবহুল প্রপার্টি কিনেছেন পাচারকারীরা। মূলত দুবাইয়ের গোল্ডেন ভিসা থাকায় ৪৫৯ বাংলাদেশি পাচার করা টাকা দিয়ে ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয় করেছে। অর্থপাচার করা এই বাংলাদেশিদের বিষয়ে অনুসন্ধানে টিম গঠন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। টিমের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেজন্য এনবিআরকে একটি চিঠি ও ৭০ জন অর্থপাচারকারীর তালিকা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দুদকের উপপরিচালক ও টিম লিডার রাম প্রসাদ মন্ডল সই করা তালিকাসহ একটি চিঠি এনবিআর চেয়ারম্যানকে দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, ৪৫৯ জন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মূলধন সুইস ব্যাংকসহ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের পাচার করেছে। যা পরবর্তীতে দুবাইয়ে স্থানান্তর করে সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষের গোল্ডেন ভিসা সুবিধায় ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে দুদক থেকে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। অনুসন্ধানের স্বার্থে চিঠির সঙ্গে টাকা পাচার করে সুইস ব্যাংক ও দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়কারী ৭০ জনের নামের তালিকা দেওয়া হয়েছে। তালিকায় বাংলাদেশির নাম, জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট নাম্বার ও জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন নাম্বার দেওয়া হয়েছে। তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের ই-টিআইএন, আয়কর রিটার্নসহ সকল তথ্য সম্বলিত রেকর্ড অনুসন্ধান টিমকে প্রদান করতে চিঠিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তালিকায় যাদের নাম রয়েছেন, তারা হলেন-আহসানুল করীম, আনজুমান আরা শহীদ, হেফজুল বারী মোহাম্মদ ইকবাল, হুমায়রা সেলিম, জুরান চন্দ্র ভৌমিক, মো. রাব্বী খান, মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ অলিউর রহমান, এস এ খান ইখতেখারুজ্জামান, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সৈয়দ ফাহিম আহমেদ, সৈয়দ হাসনাইন, সৈয়দ মাহমুদুল হক, সৈয়দ রুহুল হক, গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া, হাজী মোস্তফা ভূঁইয়া, মনজ কান্তি পাল, মো. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, মো. মাহবুবুল হক সরকার, মো. সেলিম রেজা, মোহাম্মদ ইলিয়াস বজলুর রহমান, এস ইউ আহমেদ, শেহতাজ মুন্সী খান, এ কে এম ফজলুর রহমান, আবু ইউসুফ মো. আবদুল্লাহ, চৌধুরী নাফিজ সারাফাত, গুলজার আলম চৌধুরী, হাসান আশিক তাইমুর ইসলাম, হাসান রেজা মহিদুল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ। এম সাজ্জাদ আলম, মোহাম্মদ ইয়াসিন আলী, মোস্তফা আমির ফয়সাল, রিফাত আলী ভূঁইয়া, সালিমুল হক ঈসা বা হাকিম মোহাম্মদ ঈসা, সৈয়দ এ কে আনোয়ারুজ্জামান বা সৈয়দ কামরুজ্জামান, সৈয়দ সালমান মাসুদ, সৈয়দ সাইমুল হক, আবদুল হাই সরকার, আহমেদ সামীর পাশা, ফাহমিদা শবনম চৈতি, মো. আবুল কালাম, ফাতেমা বেগম কামাল, মোহাম্মদ আল রুমান খান, মায়নুল হক সিদ্দিকী, মুনিয়া আওয়ান, সাদিক হোসেন মো. শাকিল, আবদুল্লাহ মামুন মারুফ, মোহাম্মদ আরমান হোসেন, মোহাম্মদ শওকত হোসেন সিদ্দিকী, মোস্তফা জামাল নাসের, আহমেদ ইমরান চৌধুরী, বিল্লাল হোসেন, এম এ হাশেম, মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন চৌধুরী, নাতাশা নূর মুমু, সৈয়দ মিজান মোহাম্মদ আবু হানিফ সিদ্দিকী, সায়েদা দুররাক সিনদা জারা, আহমেদ ইফজাল চৌধুরী, ফারহানা মোনেম, ফারজানা আনজুম খান, কে এইচ মশিউর রহমান, এম এ সালাম, মো. আলী হোসেন, মোহাম্মদ ইমদাদুল হক ভরসা, মোহাম্মদ ইমরান, মোহাম্মদ রোহেন কবীর, মনজিলা মোর্শেদ, মোহাম্মদ সানাউল্যাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ সরফুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
সূত্রমতে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলেফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূসম্পত্তি, আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সি৪এডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরো অনেক বেশি হতে পারে বলে জানা গেছে।
তথ্যমতে, ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির পরিসংখ্যানটি করা হয়েছে সি৪এডিএসের ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে। এরপর গত কয়েক বছরে দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের প্রপার্টি ক্রয়ের প্রবণতা আরো ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছে বাংলাদেশিরা, যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করে গেছেন। এমনকি বৈশ্বিক নেতিবাচক অর্থনীতির মধ্যেও দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলে দিয়েছেন বাংলাদেশিরা। ২০২০ সালে করোনার মধ্যেই দেশের নির্মাণ খাতের ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যবসায়ী দুবাই চলে যান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। দেশের ব্যবসা থেকে উপার্জিত মুনাফা প্রতিনিয়ত দুবাইয়ে স্থানান্তর করছেন তিনি। তবে তথ্য বলছে, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের গোপনে কেনা প্রপার্টির মূল্য এখন কম করে হলেও এক বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
সূত্র আরও জানায়, রিপোর্টটির সূত্র ধরেই উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় অনুসন্ধানে নামে দুদক। সেজন্য তিন সদস্যের টিম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে। যদিও দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়কারী বাংলাদেশির সংখ্যা আরও ৯০ জন বেশি। দুদকের অভিযোগ বলছে, ৫৪৯ জন বাংলাদেশির বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ সুইস ব্যাংকসহ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংকে পাচার করা হয়। পরবর্তীতে দুবাইয়ে স্থানান্তর করে সংযুক্ত আরব আমিরাতে গোল্ডেন ভিসা সুবিধায় প্রপার্টি ক্রয় করেছে।
তথ্য অনুযায়ী, দুবাই কর্তৃপক্ষ গোল্ডেন ভিসা সুবিধা চালু করার পর বাংলাদেশিদের দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়ের মাত্রা হু হু করে বাড়তে থাকে। বিত্তবান বিদেশিদের আকৃষ্ট করতে ২০১৯ সালে এ ভিসা চালু করে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থসম্পত্তির মালিকানা থাকলেই এ ভিসার জন্য আবেদন করা যায়। শর্ত সহজীকরণের পাশাপাশি ভিসা প্রক্রিয়ার জটিলতাগুলোও দূর করা হয়েছে। বাংলাদেশিদের মধ্যে ব্যাংক পরিচালক, রাজনীতিবিদ, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি অনেক পুঁজিপতিই এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। তাদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অংকের পুঁজি পাচার হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।