‘দুই বছর’ ফাইল ঘুরছে এনবিআরে, যেতে পারে আন্দোলনে

## ৬৩ জনের ডিপিসি হওয়া ফাইল নিয়ম ভেঙ্গে পাঠানো হয়েছে আইআরডিতে
## ৮৩ জন ও ২৯ জনের ব্যাচের এখনো ডিপিসি হয়নি, হয়নি চূড়ান্ত জ্যেষ্ঠতা তালিকা
## ক্ষোভে ফুঁসছে পদোন্নতি বঞ্চিতরা, যেকোন সময় আন্দোলনে যেতে পারে

রাসেল মো. শাহেদ: রবিউল (ছদ্মনাম) একজন উচ্চমান সহকারী। ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে উচ্চমান সহকারী পদে যোগদান করেন। নিয়ম অনুযায়ী, যোগদানের ৫ বছর পর তার ফিডার পদ পূর্ণ হয়েছে। অর্থাৎ সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) পদে পদোন্নতির যোগ্য হয়েছেন। বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন প্রায় আড়াই বছর আগে। কিন্তু পদোন্নতি পাননি। এনবিআরে দায়িত্বরত কর্মকর্তার কাছে শতবার ধর্না দিয়েও লাভ হয়নি। এই আড়াই বছরে তিনিসহ প্রায় সকলেই দুইটি ইনক্রিমেন্ট বঞ্চিত হয়েছেন। প্রায় ৯ বছর চাকরি করেও পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন কারো কাছে পদোন্নতির কথা বলতে পারেন না। আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রতিনিয়ত হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে তাদের। রবিউল বলেন, ‘শুধু আমি নয়, আমার মতো আরো ১৭৫ জন পদোন্নতির জন্য এনবিআরের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।’

পদোন্নতি বঞ্চিত একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে জানিয়েছেন, বর্তমানে ৬৩ জন, ২৯ জন ও ৮৩ জনের তিনটি ব্যাচের মোট ১৭৫ জনের পদোন্নতি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ফিডার পদধারী তিনটি ব্যাচ কর্মচারীরা দেশের সব কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট, আপীলাত ট্রাইব্যুনালে কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ৬৩ জনের ডিপিসি হয়েছে। ইতোপূর্বে সরাসরি ফাইল পিএসসিতে পাঠানো হত। কিন্তু ৬৩ জনের ক্ষেত্রে পূর্বের নিয়ম ভেঙ্গে ফাইল পিএসসিতে না পাঠিয়ে আইআরডিতে পাঠানো হয়েছে। অনেক দিন ধরে আইআরডিতে ফাইল পড়ে ছিলো। সম্প্রতি সেই ফাইল আবার তালাশি (কোয়ারি) দিয়ে এনবিআরে পাঠানো হয়েছে। এনবিআর এর সদস্য, প্রথম সচিব, দ্বিতীয় সচিব-সবার পেছনে শতবার ধর্না দিয়েও পদোন্নতি পাননি তারা।

৬৩ জনের ব্যাচে রয়েছেন ৩ জন সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, ৮ জন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, একজন ক্যাশিয়ার ও ৫১ জন সিপাই। সিপাই পদের ৫১ জন ৩ জানুয়ারি ২০১০, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের ৮ জন ২০১৩ সালের ১২ মার্চ, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর পদের ৩ জন ও একজন ক্যাশিয়ার ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চাকরিতে যোগদান করেন। পদোন্নতি বিধিমালা অনুযায়ী, সিপাই, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ও ক্যাশিয়ার পদে কর্মরত কর্মচারীদের ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার পদে কর্মরত কর্মচারীদের ২০২০ সালের মার্চ মাসে ফিডার পদ পূর্ণ হয়। অর্থাৎ তারা এআরও পদে পদোন্নতির উপযুক্ত হয়।

সূত্র আরো জানায়, এআরও পদে পদোন্নতি দিতে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি তথ্য চেয়ে চিঠি ইস্যু করে। বিশেষ করে ২০২০ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ফিডার পদে চাকরিকাল পূর্ণকারী কর্মচারীদের কাছ থেকে এই তথ্য নেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে-কর্মচারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল সনদ, সার্ভিস বুক, ফিডার পদে চাকরি স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত আদেশ, উচ্চ শিক্ষা গ্রহণর অনুমতি বা আদেশ, ৫ বছরের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন। এসব তথ্য নিয়ে যাচাই শেষে ২০২০ সালের ১১ জুন এনবিআর পদোন্নতির জন্য যোগ্য ৬৩ জন ফিডার পদধারী মিনিস্টোরিয়াল কর্মচারীর ‘খসড়া জ্যেষ্ঠতা’ তালিকা প্রকাশ করে। সব যাচাই শেষে এই ৬৩ জনের বিভাগীয় পদোন্নতি ও নির্বাচন কমিটির (ডিপিসি) সভা শেষ করে। পূর্বের নিয়ম অনুযায়ী ডিপিসি হওয়ার পর ফাইল পিএসসিতে পাঠানোর কথা। কিন্তু এনবিআর থেকে সেই ফাইল অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে (আইআরডি) পাঠানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে সময়ের কালক্ষেপণ করা হচ্ছে।

অপরদিকে, ২০২০ সাল ও ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ফিডার পদ পূর্ণ হওয়া ৮৩ জনের একটি ব্যাচ রয়েছে। বিভাগীয় পরীক্ষা উত্তীর্ণ এই ৮৩ জনের এনবিআর ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরপর্যন্ত তথ্য চেয়েছে। সব তথ্য দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও চূড়ান্ত জ্যেষ্ঠতা তালিকা ও ডিপিসি সভা না করে শুধুমাত্র খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা করেই এনবিআর ফেলে রেখেছে। এই ৮৩ জনের মধ্যে রয়েছে-সাঁট লিপিকার কাম কম্পিউটার অপারেটর ৫ জন, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর ১৫ জন, কম্পিউটার অপারেটর ৮ জন, উচ্চমান সহকারী ৯ জন, ক্যাশিয়ার ৪ জন ও সিপাই ৪১ জন। ২৯ জনের একটি ব্যাচের এআরও পদে পদোন্নতি দিতে ২০২০ সালের ৬ জুলাই তথ্য চেয়ে চিঠি ইস্যু করে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ফিডার পদে চাকরিকাল পূর্ণকারী কর্মচারীদের কাছ থেকে তথ্য নেয়া হয়। প্রায় দুইবছর অতিবাহিত হলেও এই ব্যাচটির ডিপিসি ও চূড়ান্ত জ্যেষ্ঠতা তালিকা করেনি এনবিআর। এই দুই ব্যাচের কর্মচারীরাও দীর্ঘদিন ধরে এনবিআরের টেবিলে টেবিলে ঘুরছেন বলে অভিযোগ করেছেন।

পদোন্নতি বঞ্চিতরা জানিয়েছেন, নিয়ম অনুযায়ী বিভাগীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ফিডার পদ পূর্ণ হলেই পদোন্নতি দেয়া হয়। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা পদে এনবিআর সরাসরি (পিএসসির মাধ্যমে) ৫০ শতাংশ ও পদোন্নতির মাধ্যমে ৫০ শতাংশ পদ পূরণ করে থাকে। সাঁট লিপিকার কাম-কম্পিউটার অপারেটর, কম্পিউটার অপারেটর, উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ও সিপাই পদ থেকে ৫০ শতাংশ হারে পদোন্নতি দেয়া হয়। কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট ও এনবিআরের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা এই পদোন্নতির সুযোগ পান। এর মধ্যে সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর, উচ্চমান সহকারী, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে ৫ বছর, অফিস সহকারী ৭ বছর ও সিপাই পদে ১০ বছর চাকরির বয়স হলে বিভাগীয় পরীক্ষার সুযোগ পান। অর্থাৎ পদোন্নতির জন্য ফিডার পদধারী হন।

পদোন্নতি বঞ্চিত একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে জানিয়েছেন, অতীতে কোন ফাইল ডিপিসি হওয়ার পর আইআরডিতে পাঠানো হয়নি। এনবিআর আমাদের পদোন্নতি বঞ্চিত করতে প্রথমবার ফাইল আইআরডিতে পাঠিয়েছে। দুই বছর ধরে ফাইল এনবিআরে পড়ে ছিলো। এই দুই বছর ধরে কর্মচারীরা এনবিআরের দ্বারে দ্বারে ধর্না দিয়েও কোন লাভ হয়নি। ৬৩ জনের মধ্যে ইতোমধ্যে অনেকের ফিডার পদ আড়াই থেকে তিন বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ চাকরি জীবনে এ সময় তারা পদোন্নতি ও চাকরির নানান সুবিধা বঞ্চিত হবেন। সম্প্রতি ফাইলটি তালাশি দিয়ে ফাইল আবার এনবিআরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এনবিআর থেকে নতুন করে এসিআরসহ কাগজপত্র চাওয়া হচ্ছে। সময় মতো পদোন্নতি না হওয়ায় তারা চাকরির বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তিনটি ব্যাচের পদোন্নতি বঞ্চিতদের দাবি, সময় মতো পদোন্নতি হলে তাদের দুই থেকে তিনটা ইনক্রিমেন্ট যোগ হতো। এনবিআরের গাফিলতির কারণে তারা সেই ইনক্রিমেন্ট থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। আবার পদোন্নতি পেলেও বয়সের কারণে ভবিষ্যতে তারা পরবর্তীতে রাজস্ব কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার হতে পারবেন না।

অভিযোগ করে তারা বলেন, তিনটি ব্যাচকে পদোন্নতি না দিয়ে উল্টো পিএসসি থেকে প্রায় আড়াইশো জন এআরও নিয়েছে এনবিআর। পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষ হলেই তারা যোগদান করবেন। অথচ করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাস্টম হাউস, ভ্যাট কমিশনারেট, ট্রাইব্যুনাল ও এনবিআরে এসব কর্মচারী কাজ করেছেন। পদোন্নতিপ্রার্থীরা সরাসরি রাজস্ব আহরণে ভূমিকা রাখলেও বছরের পর বছর তাদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। তাদের দাবি, এনবিআর পদোন্নতি না দেয়ায় তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে। পদোন্নতির জন্য যে কোন সময় তারা আন্দোলনে যেতে পারেন।

এই বিষয়ে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফাইল প্রসেস হচ্ছে। দ্রুত পদোন্নতির জট খুলবে।

###

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!