তেল পরিবহন নিয়ন্ত্রণে আ.লীগ নেতাদের হাত

২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে টেন্ডার ছাড়াই ৫৩টি তেলবাহী জাহাজ বিপিসির বহরে যুক্ত করা হয়। এই জাহাজগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলো (পদ্মা, মেঘনা, যমুনা) দ্বারা তেল পরিবহনে ব্যবহার করা হয়, এবং এগুলোর মালিক আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিপিসির বহরে তেল পরিবহনে জাহাজের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত বিপিসির বহরে থাকা ১৭৭ জাহাজের মধ্যে ১১৮টিই আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতা ও আমলাদের মালিকানাধীন বলে জানা যায়।

জ্বালানি তেল পরিবহনে ত্রুটিহীন জাপানি জাহাজগুলো সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মালিকানায় দেশে তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ জাহাজগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয় বলে তথ্য উঠে এসেছে বিপিসির নথিতেই। ‘বয়স হয়েছে’ উল্লেখ করে ৭০টি জাপানি জাহাজ জ্বালানি পরিবহনের বহর থেকে বাদ দেওয়া হয়, অথচ আইনে বয়সের কথা উল্লেখ নেই।

বিপিসির পক্ষ থেকে ২০২৩ সালের ৮ আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবকে দেওয়া এক পত্রে বিপিসির বহরে মোট ১৬২টি অয়েল ট্যাংকার থাকার কথা জানানো হয়। এর মধ্যে ১৪৩টি ট্যাংকার দেশে তৈরি। এর বেশির ভাগই আওয়ামী নেতাদের মালিকানাধীন।

বিপিসি ও তিন কোম্পানি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, জ্বালানি তেল পরিবহনে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নামে রয়েছে এমটি অনিম জালাল, ওটি নেয়ামত ও এমটি সুলতানা নামের জাহাজ। নারায়ণগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমানের নামে রয়েছে এমটি সি ব্রিজ ও জেডএন-১ নামের দুটি জাহাজ। শামীম ওসমানের আত্মীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল কবির খানের নামে রয়েছে এমটি রাশেদ, এমটি রিদা-১ সহ কয়েকটি জাহাজ।

এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল অফিসার (ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য) আলাউদ্দিন মোহাম্মদ নাসিম, ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস, তাপসের ভায়রা হাসানুল বারী, আওয়ামী লীগ নেতা ও ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি কে এম জামান রোমেল, নোয়াখালীর-১ সাবেক সংসদ সদস্য মো. ইব্রাহিম, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের নামেও একাধিক জাহাজ রয়েছে।

ময়মনসিংহ আওয়ামী লীগের নেতা ইঞ্জিনিয়ার মাহাবুব কবির, নরসিংদীর আওয়ামী লীগ নেতা শফিকুল আমিন ভুইয়া, পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হাফিজুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা খালেদ এইচ খান, চট্টগ্রাম নগর থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, আওয়ামী লীগ নেতা ও ছাগলনাইয়ার (ফেনী) সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, নরসিংদীর সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ওয়াহিদ মিয়ার নাম রয়েছে জাহাজমালিক হিসেবে। বেনজীর আহমেদের জাহাজটি অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের শেষদিকে দলের এক নেতার কাছে বিক্রি করে দেন বলে জানা গেছে। এই নেতারা কেউ আত্মগোপন, কেউ কারাগারে থাকায় তাঁদের বক্তব্য জানা যায়নি।

বিপিসির বহরে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের তিনটি জাহাজ রয়েছে: এমটি অনিম জালাল, ওটি সুলতানা এবং ওটি নেয়ামত, যা পরিচালনা করেন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতা মুনতাসীর মামুনের ভাতিজা ইয়ামিন। শামীম ওসমানের দুটি জাহাজ, এজেডএন-১ এবং সিব্রিজ, দেখাশোনা করেন সুপারভাইজার কামরুল, তবে বর্তমানে তত্ত্বাবধান করছেন বিএনপির এক নেতা। আওয়ামী লীগ নেতা কে এম জামান রোমেলের দুটি জাহাজ, পিপলস-১ এবং পিপলস-২, দেখাশোনা করেন রেজাউল করিম বাদল, যিনি নিজেকে জামান রোমেলের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন।

বিপিসির পরিচালক (অপারেশন) অনুপম বড়ুয়া দাবি করেন, নীতিমালা অনুযায়ী জাহাজ বিপিসির বহরে যুক্ত করা হয়। এখানে কোনো অনিয়ম হয় না। জাহাজের বয়স ৪০ বছরের পর আর চুক্তি নবায়ন করা হয় না। কারণ ৪০ বছরের বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ অয়েল ট্যাংকার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি আবুল বশর আবু জানান, বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠরা দলীয় বিবেচনায় বিনা টেন্ডারে অবৈধভাবে অসংখ্য জাহাজকে বিপিসির বহরে যুক্ত করেন। এতে তাঁরা ফায়দা লুটে নিলেও ক্ষতি হয় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের।

তিনি আরও বলেন, তেল পরিবহনের ক্ষেত্রে জাহাজের ৪০ বছর বয়সের কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ৪০ বয়সী জাহাজগুলোকে বিপিসির বহর থেকে বাদ দেওয়া হয়। অথচ এটার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম জানান, কোস্টাল ট্যাংকার বা মার্চেন্ট শিপগুলো সারা বছর সাগর পাড়ি দিয়ে তেল পরিবহন করতে পারবে। এগুলো মার্চেন্ট শিপিং অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর আওতায় নিবন্ধিত এবং বিশ্বের মানসম্মত লোর্ড লাইন, ক্লাস ও সেপটি কসন্ট্রাকশনের শিপ হয়। ইনল্যান্ড শিপিং অধ্যাদেশ ১৯৭৬ অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ নৌযানে ৩০ বছরের বয়সসীমা থাকলেও কোস্টাল জাহাজের জন্য কোনো বয়সসীমা নেই এবং এই জাহাজগুলো নির্দিষ্ট সময়, ১৫ নভেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, সাগর অতিক্রম করতে পারবে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে বছরে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়, যার মধ্যে ৫০ লাখ টন নদীপথে পরিবহন করা হয়। এই তেল পরিবহনে প্রায় ৭০ শতাংশের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, নেতা ও আমলাদের মালিকানাধীন জাহাজে পরিবহন করা হয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!