তেল আমদানিতে বিপর্যয়, দিতে হবে চড়া দাম

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত এখনও পুরোপুরি শান্ত না হতেই নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে। এই সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে জ্বালানি তেল আমদানিতে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে বাংলাদেশকে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশ সরাসরি ইরান বা ইসরায়েল থেকে পণ্য আমদানি করে না, তবু ইরানের হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে বাড়তে পারে। যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। যদিও সরকার বলছে, আপাতত বড় ধরনের ঝুঁকি নেই, তবে বিশেষজ্ঞরা এখনই বিকল্প উৎস খুঁজে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের ২০ শতাংশ এবং অপরিশোধিত তেলের ৩০ শতাংশ পরিবহন করা হয়। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হলে এই রুটে তেল পরিবহন ব্যাহত হয়ে বাংলাদেশে তীব্র জ্বালানি সংকট দেখা দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য সংস্থা (ইআইএ) জানিয়েছে, বিশ্বে দৈনিক ব্যবহৃত তেলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ—প্রায় ১ কোটি ৮০ থেকে ১ কোটি ৯০ লাখ ব্যারেল—এই হরমুজ প্রণালির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে অনেক তেলবাহী জাহাজ আটকা পড়বে, ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ব্যাপকভাবে বাড়বে। ইতিমধ্যেই অপরিশোধিত তেলের দাম হঠাৎ করে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অপরিশোধিত তেলের প্রধান মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়ে ব্যারেলপ্রতি দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ১৫ ডলারে, যা গত পাঁচ মাসে সর্বোচ্চ।

ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে মোট ১৪ লাখ টন জ্বালানি তেল মজুদের সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে মজুদ রয়েছে মাত্র ৪৫ দিনের জন্য। ফলে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত যদি যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে বাংলাদেশ জ্বালানি সংকটে পড়তে পারে। কারণ, দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪ শতাংশ এবং গণপরিবহনের প্রায় ৯০ শতাংশই জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। কৃষি খাত, বিশেষ করে সেচকাজও অনেকাংশে তেলনির্ভর। বর্তমানে দেশে ডিজেল, পেট্রোল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল, মেরিন ফুয়েল ও বিমানের জ্বালানিসহ গড়ে বছরে ৭২ লাখ টন তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ পূরণ হয় স্থানীয়ভাবে, বাকিটা আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সৌদি আরবভিত্তিক অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (অ্যাডনক) থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে।এ ছাড়া জিটুজি (সরকারি পর্যায়ে চুক্তি) ও আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে আরও আটটি দেশ থেকে পরিশোধিত তেল আমদানি করা হয়। তবে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ক্রমেই তীব্র হওয়ায় দেশের জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে কি না—সে নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে প্রায় ৭২ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ স্থানীয়ভাবে পূরণ হয়, বাকি ৯২ শতাংশ আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। বিপিসি সৌদি আরবের আরামকো ও আবুধাবির অ্যাডনক থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। আর পরিশোধিত তেল সংগ্রহ করা হয় আটটি দেশের সঙ্গে জিটুজি (সরকারি পর্যায়ের চুক্তি) এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৫৯ লাখ ১০ হাজার টন পরিশোধিত এবং ১৪ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করেছে, যার জন্য ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ৬৩ লাখ ৭১ হাজার টন তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৫৫ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা। সে সময় পরিশোধিত তেলের জন্য ৪২,০৬৭ কোটি, ফার্নেস অয়েলের জন্য ৪,১০৩ কোটি, মেরিন ফুয়েলের জন্য ১০৭ কোটি এবং অপরিশোধিত তেলের জন্য ৯,৩৮৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। তবে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের কারণে যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আগামী অর্থবছরে এই ব্যয় কত বাড়বে তা অনুমান করাও কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মো. তামিম। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সংঘাত প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা জ্বালানি বাজারে স্থায়ী অস্থিরতা তৈরি করছে।

এতে সারা বিশ্বের জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ইরান-ইসরায়েলের নতুন সংঘাতের প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। যেহেতু বাংলাদেশ জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরশীল, তাই বিকল্প উৎস খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যদিও সম্প্রতি ব্রুনাইসহ কয়েকটি দেশের সঙ্গে চুক্তির আলোচনাসমূহ চলছে এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশ থেকেও তেল আমদানি হচ্ছে, সেই পরিমাণ আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান বলেছেন, বিগত সরকার ইআরএল-২ বাস্তবায়নের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, কিন্তু প্রকৃত কোনো কাজ হয়নি। তাই এখন আমরা চাইলেও মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে পারছি না। তবে আমরা এই বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ সরাসরি ইরান বা ইসরায়েল থেকে কোনো পণ্য আমদানি করে না। যেহেতু যুদ্ধ পরিস্থিতি চলছে, তাই বিশ্বজুড়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তবে সৌদি আরব ও দুবাইয়ের তেল সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো আমাদের কোনো সমস্যার সম্মুখীন করবে না বলে আশ্বস্ত করেছে।

চাহিদা বিবেচনায় মজুদ সক্ষমতা বাড়াতে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এই প্রকল্পগুলো সফলভাবে সম্পন্ন হলে নতুন করে ২ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০ টন তেল মজুদ করার সুবিধা সৃষ্টি হতো, যা দেশের মোট চাহিদার প্রায় এক-চতুর্থাংশের সমান। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো প্রকল্পই শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, যেহেতু ওই দুই দেশ থেকে সরাসরি কোনো পণ্য আমদানি করা হয় না, তাই যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত না হয়, তাহলে দেশের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। তবু বিকল্প উৎস খুঁজে বের করার কাজ চলছে এবং কোনোভাবেই দেশে জ্বালানি তেলের সংকট সৃষ্টি না হয়—সেদিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!