বিগত সরকারের সময় থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে প্রতিকূল নীতিমালার কারণে দেশের টেক্সটাইল শিল্প গভীর সংকটে পড়েছে। এতে করে প্রায় ৯০ শতাংশ টেক্সটাইল মিল মালিক ব্যবসা থেকে সরে যাওয়ার উপায় খুঁজছেন বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্ট নেতারা।
শনিবার (৫ জুলাই) রাজধানীর গুলশান ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে, কিন্তু সরবরাহ নেই। রপ্তানির প্রণোদনা একসময় যেখানে ২৫ শতাংশ ছিল, তা কমে এখন মাত্র ১ শতাংশ। ব্যাংকগুলোতেও অর্থসংকট। এর মধ্যে নতুন করে তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শিল্প খাত টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে ৯০ শতাংশ মিল মালিক লোকসানের মধ্যেও কারখানা বিক্রির কথা ভাবছেন। আমরা মরতে বসেছি (উই আর ডাইং)।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটি নতুন আরোপিত অগ্রিম আয়কর, ভ্যাট এবং করপোরেট কর অবিলম্বে কমানোর দাবি জানিয়েছে। সম্মেলনের পরে বিটিএমএর এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্তত ৫০টি টেক্সটাইল মিল বিক্রির জন্য চেষ্টা চলছে।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, এই সংখ্যা ৫০টির বেশি হবে। আমার দুটি স্পিনিং মিলের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত একটি বিক্রি করতে চাই, এরপর অন্যটিও বিক্রির পরিকল্পনা রয়েছে। বিটিএমএর অধীনে প্রায় ১,৮০০টি টেক্সটাইল মিল রয়েছে, যার মধ্যে ৫০০টিরও বেশি স্পিনিং মিল।
মিল বিক্রির কারণ ব্যাখ্যা করে খোরশেদ আলম বলেন, আগেই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন কর ও ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ইয়ার্ন বিক্রি করতে হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকা অসম্ভব করে তোলে। তিনি আরও বলেন, প্রতি কেজি ইয়ার্ন এখন ৪ টাকা লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার টেক্সটাইল খাতের কর্পোরেট কর হার ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৭.৫ শতাংশ করেছে। পাশাপাশি তুলা আমদানির ওপর ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপ করা হয়েছে এবং স্থানীয় উইভিং মিলের জন্য ইয়ার্ন বিক্রিতে ভ্যাট কেজিপ্রতি ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হয়েছে। নতুন ভ্যাট বাজেট ঘোষণার দিন থেকে কার্যকর হয়েছে, আর নতুন কর ১ জুলাই থেকে প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এই কর বৃদ্ধির ফলে তুলা আমদানিকারকরা হঠাৎ করের উচ্চ পরিমাণের কারণে বন্দর থেকে তুলার কনসাইনমেন্ট ক্লিয়ার করতে আপাতত বিরতি দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিটিএমএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, সোমবার (৭ জুলাই) পর্যন্ত সরকার যদি কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে সরে না আসে, তবে তা বুমেরাং হয়ে খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না। রাজস্ব কর্তৃপক্ষ জানায়, তুলা ও কৃত্রিম ফাইবারের মতো কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত এই অগ্রিম আয়কর কারিগরি দৃষ্টিকোণ থেকে সমন্বয়যোগ্য।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান আগেই বলেছেন, বছর শেষে হিসাব করলে অতিরিক্ত ট্যাক্স পরিশোধ হলে তা পরবর্তীতে সমন্বয় করার সুযোগ রয়েছে। এনবিআরের এক কর্মকর্তা, নাম প্রকাশ না করার শর্তে, জানান, প্রদেয় অগ্রিম আয়কর (এআইটি) এর তুলনায় যদি লাভ কম হয়, তাহলে ওই অর্থ রিফান্ড হবে না। তবে পরবর্তী বছরে যদি মুনাফা হয়, তখন সেটি সঙ্গে সমন্বয় করার সুযোগ থাকে।
তবে বিটিএমএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন সরকার ঘোষিত নীতির কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, সরকারি কোষাগারে একবার টাকা গেলে তা ফেরত পাওয়ার কোনো নজির নেই। টেক্সটাইল খাতের আরও অন্তত তিনজন উদ্যোক্তা একই মত পোষণ করেছেন। তারা বলেন, বাংলাদেশের সরকারকে কর পরিশোধের পর টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো উদাহরণ নেই। এই পরিস্থিতিতে নতুন করের টাকা পরিশোধের জন্য ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নিতে হবে বলে জানান তারা।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) এবং বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল ও লিনেন প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতিসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠন বিটিএমএর দাবির প্রতি সমর্থন জানায়।