সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যাংকে জমা রাখেন এবং নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন। তবে সুদ বেশি হলেও সঞ্চয়পত্র কেনার প্রবণতা কমেছে। এমনকি সঞ্চয়পত্র ভাঙার প্রবণতাও বেড়েছে। গত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে গ্রাহকরা ২৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙেছেন। এদিকে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্র কেনার হার ২৭ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) ৩০ হাজার ১০৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিক্রি হয়েছিল ৪১ হাজার ২৯০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এর মানে, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে ১ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা, যা প্রায় ২৭ শতাংশ।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া এবং ভাঙার হার বেড়ে যাওয়ার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে, যা অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারেরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়েছে, অথচ আয় বাড়ছে না, ফলে অনেকেই সঞ্চয়পত্র ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া, কিছু ব্যাংক গ্রাহকের টাকা পরিশোধে অক্ষম, যা আস্থাহীনতার সৃষ্টি করেছে এবং অনেক গ্রাহক সঞ্চয়পত্র ভাঙছেন। এর পাশাপাশি, সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক হিসাব জব্দ ও স্থগিতের মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে আগ্রহ হারিয়েছেন।
সাধারণ মানুষের মধ্যে সঞ্চয়পত্র কেনার তুলনায় ভাঙার প্রবণতা বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৩২ হাজার ৩৫৪ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙা হয়েছে। এর মধ্যে অক্টোবরে ৯ হাজার ৮৩ কোটি, নভেম্বরে ৮ হাজার ১৫০ কোটি এবং ডিসেম্বরে ৮ হাজার ৪৬১ কোটি সঞ্চয়পত্র ভাঙা হয়েছে, যা মোট ২৫ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার সমান। এর ফলে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত বিক্রি ২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা কমে গেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমেছিল ৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা।
এদিকে বিক্রি কমে যাওয়ার অর্থ হলো, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া কমছে। এতে সরকারকে সুদও কম গুনতে হবে। তবে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধের জন্য সরকারকে এখনো বাজেটে বড় অঙ্কের অর্থ বরাদ্দ রাখতে হচ্ছে।শুধু তা–ই নয়, সঞ্চয়কারীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করতে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার গত জানুয়ারিতে বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের আওতায় পরিচালিত সঞ্চয় কর্মসূচিগুলোর (স্কিম) মুনাফার হার বেড়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ৭৮ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা। তার বিপরীতে গ্রাহকেরা সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছেন ৯৯ হাজার ৯৭২ কোটি টাকার। অর্থাৎ নিট বিক্রি ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকা কমেছে। তার মানে সরকার গত অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ এক টাকাও পায়নি। নিট বিক্রিকে সরকারের ঋণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুন শেষে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর শেষে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৩৩৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর প্রধান কারণ হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মজুরি বৃদ্ধি যা ব্যয়ের তুলনায় অনেক কম, এ কারণে মানুষকে সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। পাশাপাশি, ব্যাংকগুলোর ওপর গ্রাহকদের আস্থা কমে গেছে এবং অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না, যা সঞ্চয়পত্র ভাঙার হার বাড়াচ্ছে।
সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়া ও ভাঙার হার বেড়ে যাওয়ার প্রভাব সম্পর্কে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার বর্তমানে আর্থিক সংকটে রয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আদায় আশানুরূপ নয় এবং বৈদেশিক অর্থায়নও প্রত্যাশিত পরিমাণে আসছে না। এমন পরিস্থিতিতে সঞ্চয়পত্র সরকারী অর্থের জোগানের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি কমে যাওয়া ও ভাঙার হার বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, যার ফলে অর্থবছরের মাঝপথে বাজেট কর্তন বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) আরও কমানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
**নগদ ও সঞ্চয়পত্রের বিরোধে আটকে অনুদান
**সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বেড়েছে ১২.৫৫%
**সরকারি কর্মচারীদের সঞ্চয়ে ১৩% পর্যন্ত মুনাফার সুযোগ