তিতাসে সিস্টেম লসের নামে গ্যাস ডাকাতি!

গ্যাস সংকটের এই সময়ে একটি বৈধ সংযোগ পেতে দুর্ভেদ্য আমলা চক্রের বাধার মুখে পড়তে হলেও অবৈধ সংযোগ দেওয়া থেমে নেই।একদিকে লোক দেখানো অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার অভিযান চলে, অন্যদিকে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি গতিতে চলে চক্রগুলোর অবৈধ সংযোগ দেওয়ার তৎপরতা।

বিপুল গ্যাস চুরিকেও সিস্টেম লস দেখিয়ে কার্যত এই চোর চক্রকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।১৯৯৬ সালের একটি আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন-বিইআরসি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাসকে ২ শতাংশ সিস্টেম লস হিসাব করার সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু সিস্টেম লস বেড়েছে এর কয়েকগুণ, অর্থাৎ কমে আসার পরিবর্তে চুরির কারণে সিস্টেম লস বছর বছর বাড়ছে।

গ্যাস খাতে সিস্টেম লসের নামে কর্মকর্তাদের প্রচলিত অপকর্মকে অনেকে চুরি বললেও বিইআরসির সাবেক সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী চৌধুরী এটাকে বলতে চান ‘ডাকাতি’।তিনি বলেন, ২/৩ শতাংশ গ্যাস কমে গেলে সেটাকে সিস্টেম লস বা চুরি বলা যেত। কিন্তু যেখানে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উধাও করে দেওয়া হচ্ছে এটাকে ডাকাতি না বলে পারছি না। ডাকাতি বললেও কম বলা হবে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি এর গত ডিসেম্বরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই মাসে সিস্টেম লস হয়েছে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। তখন দৈনিক প্রায় ১৩৩০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেয়েছিল তিতাস। বিক্রি দেখানো হয়েছে দৈনিক প্রায় ১১৮৯ মিলিয়ন ঘনফুট।অর্থাৎ ওই মাসে দৈনিক প্রায় ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস (১৪ কোটি ইউনিট) বিক্রির টাকা কোম্পানির কোষাগারে জমা দিতে পারেননি তিতাসের কর্মকর্তারা।

তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, গত ডিসেম্বরে ভৈরব এলাকায় বিদ্যমান সিস্টেমে দৈনিক ২ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিক্রি করা গেছে। যদিও সেখানে খরচ হয়ে গেছে দৈনিক ৩ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এখানে সিস্টেম লসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশ।তবে এ সিস্টেম লসের অন্য কারণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই এলাকায় আবাসিক গ্রাহক বেশি এবং তারা গ্যাসের চুলা অনবরত জ্বালিয়ে রাখে। কিছু কিছু চুলায় ১২০ ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস খরচ হয়ে গেছে।

তিতাসের তথ্য বলছে, ডিসেম্বরে সর্বনিম্ন সিস্টেম লস হয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগের ভালুকা এলাকায়, ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ঢাকা মহানগরীতে সিস্টেম লস ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। রাজধানীর কাছে নারায়ণগঞ্জে এই হার ২০ দশমিক ৯ শতাংশ।দেশের জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সরকার অন্তত ২৫ শতাংশ গ্যাস বিদেশ থেকে এলএনজি আকারে আমদানি করছে। আমদানি করা এসব গ্যাসের দাম প্রতি ইউনিট ১৩ ডলার থেকে শুরু করে অনেক সময় ৪০ ডলারেও ওঠানামা করে।পেট্রোবাংলার হিসাবে, আমদানি করা এসব গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৬৫ টাকা দাঁড়াচ্ছে।

বর্তমানে দেশে আট শ্রেণির গ্রাহকের কাছে গ্যাস বিক্রি করে সরকার। এর মধ্যে শিল্পখাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা, বিদ্যুৎকেন্দ্রে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা।প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা ধরলে সিস্টেম লস ও গ্যাস চুরি মিলিয়ে দৈনিক প্রায় ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে, যার বেশির ভাগটাই গ্যাস চুরির মাধ্যমে লোপাট হচ্ছে।

সিস্টেম লসের নামে এই ধরনের চর্চার সুযোগ না থাকার কথা তুলে ধরে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমরা এই সিস্টেম লস বাবদ ২ শতাংশেরও বিরোধিতা করি।তিনি বলেন, অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিগুলোতে গ্যাসের চাপ কম থাকা, আবাসিকে কম গ্যাস ব্যবহৃত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে উদ্বৃত্ত থাকছে।

তিতাসের ২৮ লাখ আবাসিক গ্রাহক রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার লাখ প্রিপেইড মিটার গ্রাহক রয়েছে। এক সময় আবাসিক গ্রাহকদের জন্য ৮২ ঘনফুট গ্যাস বরাদ্দ থাকলেও পরে সেটা ৭২ এবং এরপর ৬০ ঘনফুট করা হয়।

মকবুল-ই-ইলাহী বলেন, যেসব চুলায় প্রিপেইড মিটার বসানো হয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ ঘনফুট গ্যাস খরচ করতে পারছেন। সেই হিসাবে ২৪ লাখ আবাসিক গ্রাহকের জন্য বাড়তি যে বরাদ্দ সেগুলো তিতাস কর্মকর্তাদের অবৈধ সংযোগ দিয়ে চলে যাচ্ছে।তিনি বলেন, তিতাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাসাজশে অবৈধ সংযোগের কারণে সিস্টেম লস হচ্ছে। সিস্টেম লস বৃদ্ধির অর্থ হচ্ছে চুরি-ডাকাতি বেড়েছে।

প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ মূল্যের সঙ্গে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যের কারণে সরকারকে এ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৫৭০ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে বলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

তিতাসের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে ২১০টি শিল্প, ১২৫টি বাণিজ্যিক ও ২৭ হাজার ২৭৭টি আবাসিকসহ মোট ২৭ হাজার ৬১২টি সংযোগ ও ৬৩ হাজার ৩৮৬টি বার্নার বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এছাড়া এসব অভিযানে ১৩৮ কিলোমিটার পাইপলাইন অপসারণ করা হয়েছে।

চুরির কারণে যে সিস্টেম লস বাড়ছে তা বোঝা যায় গত দুই অর্থবছর ও গেল ডিসেম্বর-জানুয়ারির হিসাব দেখলে।২০২২-২৩ অর্থবছরে তিতাসে সিস্টেম লস হিসাব করা হয়েছিল ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ। পরের বছর ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ হয়েছিল সিস্টেম লস। গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রায় ১০ শতাংশ সিস্টেম লস দেখানো হয়েছে।

সম্প্রতি এক গণশুনানিতে তিতাস ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ সিস্টেম লসের তথ্য হাজির করেছে তুলে ধরে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে সিস্টেম লস শব্দটা ভাষার অপপ্রয়োগ ছাড়া আর কিছু নয়। এসব চুরিকে আমরা বলছি লুন্ঠনমূলক ব্যবস্থা। অপচয় ও চুরির দায় তিতাস ভোক্তার ওপর চাপাতে পারেন না।এর বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলার কথা বলেন। তার ভাষায়, আন্দোলন ছাড়া কোনো অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সাম্প্রতিক সময়ের দুই অভিযান

গাজীপুরের কাশিমপুরে গত জানুয়ারিতে তিতাসের অভিযানে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার গ্যাসের অবৈধ বিতরণ লাইন উচ্ছেদ, ৪৫০টি অবৈধ আবাসিক গ্যাস বার্নারের সংয়োগ বিচ্ছিন্ন ও ৫০০ মিটার পাইপ অপসারণ করা হয়েছে।অভিযানের সময় প্রতিটি বাসাবাড়ি তালাবদ্ধ থাকায় অভিযুক্ত কাউকে কোনো দণ্ড দেওয়া যায়নি।

অপরদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক উদ্যোগী হয়ে ৯ মার্চ ঢাকার ধানমন্ডিতে দুটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে।তিতাস গ্যাসের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে লাইন দুটি বসানো হয়েছিল বলে দুদকের কাছে অভিযোগ ছিল।সেদিন দুদক কর্মকর্তারা প্রথমে তিতাসের কার্যালয়ে গিয়ে ওই এলাকার বৈধ লাইনের তালিকা সংগ্রহ করেন এবং পরে তিতাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ধানমন্ডিতে অভিযানে যান। সেখানে রসনা বিলাস হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁয় ও গ্রিন বাংলা হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁয় মেলে অবৈধ সংযোগ।

দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রেস্তোরাঁ দুটি ঝুঁকিপূর্ণভাবে তিতাস গ্যাসের লাইন টেনে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করে তিতাস গ্যাস তথা সরকারের প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করেছে।

বাংলাদেশ গ্যাস আইন ২০১০ অনুযায়ী, অবৈধ সংযোগ, মিটারে অবৈধ হস্তক্ষেপসহ আট ধরনের অপরাধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। গ্রাহক ভেদে সবচেয়ে কম সাজা হল- অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা তিন মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। অপরাধের পুনরাবৃত্তি হলে এ সাজা হবে দ্বিগুণ। আর সর্বোচ্চ সাজা হল- অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। অপরাধের পুনাবৃত্তির ক্ষেত্রে অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে বিধান রয়েছে।

অভিযানের মধ্যেও তিতাসের সিস্টেম লস কীভাবে বেড়ে গেল, এমন প্রশ্নের জবাবে কোম্পানির এমডি শাহনেওয়াজ পারভেজ দাবি করেন, সিস্টেম লসের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ছিল। গত অক্টোবরে ১৩ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে একটু করে কমছে। ফেব্রুয়ারিতে ৯ শতাংশে নামতে পারে বলে আশা করছি।কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অবৈধ সংযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এগুলো ঠেকানো যাচ্ছে না। একদিকে বিচ্ছিন্ন করলে আরেকদিকে সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হয়। এগুলোর পেছনে প্রভাবশালী লোক থাকে, এগুলো সবারই জানা বিষয়।

সিস্টেম লসের বিষয়ে তিতাসের এমডি বলেন, তিতাসে অনেক পুরোনো লাইন আছে যেগুলো দিয়ে গ্যাস লিকেজ হয়। অন্তত ৩ শতাংশ গ্যাস লিকেজ হয় বলে আমার ধারণা। বাকি ৩ শতাংশ চুরি হতে পারে।এত বড় চুরির অপরাধ ধরা পড়ার পরও শাস্তি কেন হচ্ছে না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, শাস্তির বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেট বলতে পারবেন। কতটা শাস্তি দেওয়া হবে সেটা বিচারকের হাতে।

গ্যাস চুরি রোধে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না তা জানার জন্য জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানকে ফোন করলে তিনি সাড়া দেননি।গ্যাস চুরি ঠেকাতে না পারার বিষয়ে জানতে চাইলে, চুরি ধরা পড়ার পর লঘুদণ্ড দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, এর মাধ্যমে বোঝা যায় বর্তমানে আগের সরকার না থাকলেও চোর-ডাকাতদের চক্রের কাছে স্বয়ং রাষ্ট্র অবনত।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!