বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে বিক্রি, হুন্ডিতে মূল্য পরিশোধ

শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই ৫৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আমদানি

তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হবে বলে কয়লা আমদানির অনুমতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু যেই কেন্দ্রে সরবরাহ করা হবে, সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্র আমদানি করা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো ক্রয় চুক্তি ইস্যু করেনি। ভুয়া তথ্য দিয়ে নেয়া সেই আমদানি অনুমতি দেখিয়ে একমাসে ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে ৫৩ হাজার ৯১৬ মেট্রিক টন কয়লা। ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২৭২ ডলার (প্রায় ৫৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা) মূল্যের এই কয়লা আমদানি নীতিতে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নয়, এই কয়লা বিক্রি করা হয়েছে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে। এখানে শেষ নয়, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট এর মাধ্যমে আমদানি করা এই কয়লার মূল্য হুন্ডি বা অন্য মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। মিথ্যা তথ্যে আমদানি করা এই কয়লায় শুল্ককর ও স্থানীয়ভাবে বিক্রিতে ভ্যাট পরিশোধ করা হয়নি। এমনকি প্রতিষ্ঠান ভ্যাট অফিসকে আমদানি, বিক্রি ও ভ্যাট পরিশোধের তথ্যও দেয়নি। কয়লা আমদানিতে এমন তুঘলকি কান্ড করা প্রতিষ্ঠানটি হলো পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড। ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এই জালিয়াতি ও অনিয়ম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কাস্টম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া ও টাকা পাচারের অভিযোগ বিএফআইইউ-কে দিয়ে তদন্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট এর মাধ্যমে শুল্ককর পরিশোধ ছাড়াই আমদানি হয়েছে ৫৩ হাজার ৯১৬ মেট্রিক টন কয়লা
কয়লার আমদানি মূল্য ৪৯৬০২৭২ ডলার বা প্রায় ৫৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধের শঙ্কা
আমদানি করা কয়লা নোয়াপাড়ার গাংচিল ট্রেডিং, মেসার্স পান্না ট্রেডিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে

Parker Bangladesh.jpeg

সূত্রমতে, পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড এর বিরুদ্ধে আমদানি নীতি লংঘন করে কয়লা আমদানি ও টাকা পাচারের অভিযোগ উঠে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটকে নির্দেশ দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রতিষ্ঠানটি কেরানীগঞ্জ এর ঠিকানায় মূসক নিবন্ধন নেয়। পরে ভ্যাট কেরানীগঞ্জ সার্কেল ঠিকানা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পায়নি। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করায় প্রতিষ্ঠানের মূসক নিবন্ধন নম্বর বা বিআইএন সাময়িকভাবে স্থগিত (বিন লক) করা হয়নি। পরে কেরানীগঞ্জ সার্কেল থেকে প্রতিষ্ঠানের কাছে কয়লা আমদানি ও বিক্রির তথ্য চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠান কিছু ভ্যাট অফিসকে আংশিক তথ্য দিয়েছে। বাকি তথ্য দেয়নি। পরে সার্কেল থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য, যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছে কয়লা বিক্রি করবে বলে আমদানি অনুমতি নিয়েছে-সেই তথ্যসহ বেশ কিছু তথ্য নেয়া হয়। সেসব তথ্য যাচাই করে একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়। যাতে আমদানি নীতির লংঘন ও শুল্ককর ফাঁকির বিষয়টি উঠে আসে। তবে প্রতিবেদন অসম্পূর্ণ হওয়ায় এনবিআরের নির্দেশে ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেট যুগ্ম কমিশনার মো. লুৎফুল কবিরকে আহ্বায়ক করে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত শেষে প্রতিবেদনে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেডকে ছয়টি শর্তে ২০২৩ সালের ১০ জুন কয়লা আমদানির অনুমতি দেয়। শর্তের মধ্যে রয়েছে—নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি করা যাবে না; বিধি অনুযায়ী শুল্ককর পরিশোধ করতে হবে; আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধি-বিধান প্রতিপালন করতে হবে; আমদানি করা কয়লা কেবল কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহার করতে হবে; মূল্য পরিশোধের পূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্যান্য ব্যাংকের এডি শাথা থেকে মূল্য যাচাই করতে হবে; বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত কয়লা সরবরাহ শেষে প্রত্যায়িত দলিলাদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে হবে। কমিটি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানির ইস্যু করা ‘লেটার অব ইনটেন্ট ফর পারচেজ অব কোল’ এর সত্যতা যাচাই করেছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র কমিটিকে জানিয়েছে, বিসিএসআইআর এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আমদানি করা এই কয়লায় সালফারের পরিমাণ ১ শতাংশে বেশি হওয়ায় ২০২৩ সালের ২৭ জুলাই পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেডের অনুকূলে কোনো ধরনের ক্রয় আদেশ চুক্তি তারা করেনি।

গঠিত কমিটি কাস্টমসের এমআইএস সিস্টেম হতে আমদানির তথ্য যাচাই করে। এতে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি ২০২৩ সালের ৩০ জুলাই থেকে ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ২৭টি বিল অব এন্ট্রিতে ৫ কোটি ৩৯ লাখ ১৬ হাজার কেজি বা ৫৩ হাজার ৯১৬ মেট্রিক টন কয়লা আমদানি করেছে। ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা এই কয়লার ঘোষিত মূল্য ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২৭২ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা (২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রতি ডলার ১০৮.৮৫ টাকা হিসেবে)।

কমিটির পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেডের অধীনে ২০২৩ সালের ১০ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, এলসি ব্যতীত ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ এর অধীনে বিক্রয় চুক্তির বিপরীতে ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২৭২ ডলার মূল্যের কয়লা শর্ত সাপেক্ষে আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেডের অনুকূলে বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড ‘লেটার অব ইনটেন্ট ফর পারচেজ অব কোল’ ইস্যু করলেও ক্রয় আদেশ চুক্তি ইস্যু করেনি। যা বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড চিঠির মাধ্যমে তদন্ত কমিটিকে জানিয়েছে। পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেডের অনুকূলে কোনো কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের চুক্তি না থাকা সত্ত্বেও কয়লা আমদানি করা আমদানি অনুমতির সুস্পষ্ট লংঘন। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি ভুয়া তথ্য দিয়ে জালিয়াতি করে এই কয়লা আমদানি করেছে। আবার আমদানির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ক্লিয়ারেন্স ইস্যু করা হয়নি।

Parker Bangladesh.jpeg 1

পর্যালোচনায় আরো দেখা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ইস্যু করা আমদানি অনুমতির ৪নং শর্ত অনুযায়ী শুধুমাত্র তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্প প্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য কয়লা আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আমদানি করা কয়লা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহূত হয়নি। এসব কয়লা স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে। পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেডের আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকে হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট গাংচিল ট্রেডিং, নোয়াপাড়া নামের প্রতিষ্ঠান থেকে ৫০ লাখ টাকা ও ২ অক্টোবর ৬০ লাখ টাকা পার্কার বাংলাদেশের হিসাবে জমা হয়েছে। একইসঙ্গে ১ অক্টোবর মেসার্স পান্না ট্রেডিং নোয়াপাড় ৪৪ লাখ টাকা, ২ অক্টোবর এক কোটি ২৪ লাখ টাকা, ৪ অক্টোবর ৩২ লাখ টাকা, ৮ অক্টোবর ২৬ লাখ টাকা, ১১ অক্টোবর ৪ লাখ টাকা, ৫ নভেম্বর ১০ লাখ টাকা জমা হয়েছে। এই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পার্কার বাংলাদেশ এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের কাছে আমদানি করা কয়লা বিক্রি করে দিয়েছে। আমদানি করা শর্তের সুস্পষ্ট লংঘন করে এই কয়লা বিক্রি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পার্কার বাংলাদেশ ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২৭২ ডলার মূল্যের কয়লা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট এর মাধ্যমে আমদানি করলেও কতদিনের মধ্যে এই টাকা পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হবে, তার তথ্য দাখিল করেনি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি আমদানি করা এই কয়লার মূল্য হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে পরিশোধ করেছে বা পাচার করেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, যা মানিলন্ডারিং এর মধ্যে পড়ে। বিষয়টি তদন্ত করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে অবহিত করতে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। আমদানি নীতি লংঘন করে বিক্রি করা এই কয়লায় আমদানির শর্তানুযায়ী সঠিকভাবে ভ্যাট পরিশোধ করার কথা। কিন্তু ভ্যাট ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের আওতাধীন কেরানীগঞ্জ সার্কেল থেকে প্রতিষ্ঠানকে বারবার চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান এই কয়লা আমদানি মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত কোনো দলিলাদি ভ্যাট অফিসকে দেয়নি। ফলে কয়লার মূল্য হুন্ডি বা অন্য মাধ্যমে মানিলন্ডারিং করে মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে বলে কমিটি আশঙ্কা করছে।

কমিটি প্রতিবেদনে দুইটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো—আমদানি নীতি আদেশ লংঘনের দায়ে কাস্টমস আইন, ১৯৬৯ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কাস্টম হাউসকে চিঠি দেয়া যেতে পারে। অপরটি হলো—প্রতিষ্ঠানের ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা ৫৩ হাজার ৯১৬ মেট্রিক টন স্টিম কয়লার ঘোষিত মূল্য ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ২৭২ ডলার কিভাবে পরিশোধ করা হয়েছে, সেই বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অধিকতর তদন্ত করে বের করতে পারে।

অপরদিকে, এই বিষয়ে বক্তব্য জানতে পার্কার বাংলাদেশ লিমিটেড এর মোবাইল নাম্বারে কয়েকদিন ফোন দেয়া হলেও কেউ রিসিভ করেননি। পরে বক্তব্যের বিষয় লিখে প্রতিষ্ঠানকে ই-মেইল করা হলেও কোনো জবাব দেয়া হয়নি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!