‘তরঙ্গ চার্জে’ ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে বাংলালিংককে

অবশেষে বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেডকে তরঙ্গ চার্জের (স্পেকট্রাম) ওপর ভ্যাট দিতে হচ্ছে। তবে ১৫ শতাংশ নয়, পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। ভ্যাট পরিশোধের জন্য চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাংলালিংকের দেওয়া কাগজপত্র যাচাই ও এনবিআরের আদেশ (এসআরও) অনুযায়ী দাবিনামা চূড়ান্ত করা হয়েছে।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বিটিআরসির ভ্যাট নিবন্ধন নেই-এমন অজুহাতে দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাট দেয়নি বাংলালিংক। পরে মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ে এনবিআরকে অনুরোধ করে বিটিআরসি। সে অনুযায়ী বাংলালিংককে প্রাথমিক দাবিনামার পর সম্প্রতি চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করেছে এনবিআরের আওতাধীন বৃহৎ করদাতা ইউনিট (এলটিইউ-মূসক)। তিন মাসের তরঙ্গ চার্জের বিপরীতে বাংলালিংককে এক কোটি ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৪ টাকা ভ্যাট পরিশোধে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়েছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি এলটিইউ কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর সইয়ে চূড়ান্ত দাবিনামা জারি করা হয়, যাতে ‘বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশন্স লিমিটেড কর্তৃক ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত মেয়াদের রেভিনিউ শেয়ারিং, স্পেকট্রাম চার্জ এবং সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসওএফ) বাবদ বিটিআরসিতে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে উৎসে কর্তনের বকেয়া পরিশোধ’ করতে বলা হয়েছে। বাংলালিংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর সেই দাবিনামা জারি করা হয়। বকেয়া পরিশোধে বাংলালিংককে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়।

এলটিইউ’র চূড়ান্ত দাবিনামায় বলা হয়, বাংলালিংক থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসের তিনটি সেবার বিপরীতে পরিশোধিত অর্থের ওপর অপরিশোধিত ভ্যাট আদায় করতে ২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর এলটিইউকে চিঠি দেয় বিটিআরসি। সেবার মধ্যে রয়েছে রেভিনিউ শেয়ারিং, তরঙ্গ চার্জ ও এসওএফ। বিটিআরসির চিঠিতে বলা হয়, তিনটি খাতে বিটিআরসিতে পরিশোধিত অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে মূসক (ভ্যাট) হিসাবে ১৩ কোটি ৪৮ লাখ ৪৪ হাজার ৬১৮ টাকা পরিশোধ করেনি বাংলালিংক। এর মধ্যে রেভিনিউ শেয়ারিং খাতে আট কোটি ৩৭ লাখ ৪৬ হাজার ৭৩২ টাকা, তরঙ্গ চার্জ খাতে তিন কোটি ৫৯ লাখ ৩৬ হাজার ৫২ টাকা এবং এসওএফ খাতে এক কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার ৮৩৪ টাকা রয়েছে। বিটিআরসির চিঠি অনুযায়ী এ ভ্যাট পরিশোধে ভ্যাট আইন অনুযায়ী চলতি বছরের ২৬ আগস্ট বাংলালিংকে দাবিনামা-সংবলিত প্রথম কারণ দর্শানোর নোটিস জারি করে এলটিইউ।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৬ সেপ্টেম্বর লিখিত জবাব দেয় বাংলালিংক। জবাবে বলা হয়, এনবিআরের আদেশ (এসআরও-২/মূসক/২০১৮) অনুযায়ী, ফোর-জি লাইসেন্স ইস্যু বা নবায়নের ক্ষেত্রে বিটিআরসি কর্তৃক প্রাপ্ত লাইসেন্স বা টেকনোলজি নিউট্রালিটি ফি বা তরঙ্গ ফি বা চার্জ বা রয়ালিটি ফি বাবদ নির্ধারিত অর্থের ৩৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ ট্যারিফ মূল্য নির্ধারিত রয়েছে। অর্থাৎ তরঙ্গ চার্জ বাবদ বিটিআরসিতে পরিশোধিত অর্থের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। আরও একটি আদেশে (এসআরও-১২/মূসক/২০১৩) বলা হয়, দ্বৈতকর পরিহারের লক্ষ্যে রেভিনিউ শেয়ারিংয়ের বিপরীতে মূসক অব্যাহতি রয়েছে। এছাড়া সোশ্যাল অবলিগেশন ফান্ড (এসডিএফ) খাতটি ভ্যাট আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী অব্যাহতিপ্রাপ্ত। সে অনুযায়ী বিটিআরসিতে পরিশোধিত অর্থের বিপরীতে ভ্যাটের হিসাবটি পুনর্গণনার অনুরোধ জানানো হয়।

দাবিনামা চূড়ান্ত করতে ১৪ অক্টোবর শুনানি নেয় এলটিইউ। এতে বাংলালিংকের দুই কর্মকর্তা উপস্থিত হয়ে লিখিত জবাবের পুনরাবৃত্তি করেন। এছাড়া এসওএফের বিষয়ে বলা হয়, দ্বিতীয় তফসিলের দফা ২(চ) মোতাবেক ‘ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত নয়, এমন সামাজিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম’ প্রবিধান বিদ্যমান থাকায় এটিও মূসক অব্যাহতিপ্রাপ্ত। বাংলালিংকের যুক্তি ও এনবিআরের আদেশ অনুযায়ী, শুধু তরঙ্গ চার্জের ওপর পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট নির্ধারণ করে দাবি চূড়ান্ত করা হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিন মাসে তরঙ্গ চার্জ ২৩ কোটি ৯৫ লাখ ৭৩ হাজার ৬৮২ টাকার ওপর পাঁচ শতাংশ হারে ভ্যাট এক কোটি ১৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৪ টাকা। এ ভ্যাট পরিশোধে বাংলালিংককে ১৫ দিনের সময় দেওয়া হয়।

এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বিটিআরসি এনবিআরকে চিঠি দেয়, যাতে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক ও রবি থেকে বিটিআরসিতে পরিশোধিত সেবার অর্থের বিপরীতে ভ্যাট আদায় করতে বলা হয়। অর্থাৎ ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১১ মাসের ভ্যাট আদায় করতে বলা হয়। এর মধ্যে রেভিনিউ শেয়ারিং, তরঙ্গ চার্জ, এসওএফ, টু-জি, থ্রি-জি ও ফোর-জি লাইসেন্স ফি। বিটিআরসিকে বাংলালিংকের পরিশোধিত মোট সেবা চার্জ ৪৮৭ কোটি ৭৯ লাখ ৩৭ হাজার ১৮৯ টাকার বিপরীতে ১৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য ভ্যাট (এআইটিসহ) ৮১ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫৩২ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধিত রেভিনিউ শেয়ারিং ১৫২ কোটি ৪৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩ টাকা, তরঙ্গ চার্জ ৬৪ কোটি ৮৯ লাখ ৮০ হাজার ৭৫৩ টাকা, এসওএফ ২৬ কোটি ৬৯ লাখ ৩৬ হাজার ৭৫৩ টাকা, লাইসেন্স ফি ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ও তরঙ্গ বিক্রি (ফোর-জি) ২৩০ কোটি ২৪ লাখ ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা।

সূত্র আরও জানায়, বিটিআরসির চিঠি অনুযায়ী এআইটি বাদে ভ্যাট ৭৩ কোটি ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫৮৭ টাকা পরিশোধের জন্য চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলালিংককে চিঠি দেয় এলটিইউ। এরপর ছয়বার তাগাদাপত্র দেওয়া হলেও ভ্যাট পরিশোধ করেনি বাংলালিংক। ২১ জুলাই সর্বশেষ চিঠি দেওয়া হয়, যাতে ভ্যাট পরিশোধ না করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। এর পরই টনক নড়ে বাংলালিংক কর্তৃপক্ষের। ১১ মাসের মধ্যে মাত্র তিন মাসের ভ্যাট পরিশোধের দাবিনামা চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।এ বিষয়ে বাংলালিংকের হেড অব করপোরেট (কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড সাস্টেইনিবিলিটি) আংকিত সুরেকা বলেন, দেশের সব ধরনের আইন অনুসরণ করে কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে বাংলালিংক সব সময় বদ্ধপরিকর। ভ্যাট নিয়ে একটি কার্যকর সমাধানের লক্ষ্যে আমরা এলটিইউ’র সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!