ডিজিটাল লেনদেনের বাধা কর-শুল্ক

নগদ টাকা বহনে নানা ঝামেলা রয়েছে—জাল নোটের ঝুঁকি, ছিনতাইয়ের ভয় এবং অপরাধমূলক লেনদেনের আশঙ্কা। এসব সমস্যা এড়াতে বিশ্বজুড়ে লেনদেন ডিজিটাল করার প্রবণতা বাড়ছে। অনেক দেশ ইতোমধ্যে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’ গড়ে তুলেছে।

বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল লেনদেন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যেখানে নগদ লেনদেন ন্যূনতম পর্যায়ে রাখা হয় এবং ‘লেস ক্যাশ’ অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়া হয়। এসব দেশে গ্রাহক ও ব্যবসায়ীরা সহজেই সব ধরনের অর্থপ্রদান ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারেন। বাংলাদেশও একই লক্ষ্যে এগোতে চায়, তবে এখানে এখনো নীতিগত জটিলতা রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, ক্রেডিট কার্ড নিতে হলে আয়কর রিটার্নের কপি জমা দিতে হয়, যা অনেকের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি, ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহিত করার জন্য কোনো প্রণোদনা নেই, বরং প্রতিটি লেনদেনে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও নানা চার্জ আরোপ করা হয়।

এসব অতিরিক্ত কর ও চার্জের কারণে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এবং অনেকেই বাধ্য হয়ে নগদ লেনদেনের দিকেই ঝুঁকছেন। বর্তমানে দেশে মাত্র ২৫ লাখ ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক রয়েছে, যা সংখ্যাগতভাবে বেশ কম। অন্যদিকে, ব্যাংকে আমানত রাখলে যেমন বিভিন্ন চার্জ কেটে রাখা হয়, তেমনি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করলেও গ্রাহকদের ওপর ভ্যাট, ট্যাক্সসহ নানা অতিরিক্ত খরচ চাপানো হয়। এমনকি এসব কার্ড আমদানির ক্ষেত্রেও শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ডিজিটাল লেনদেনকে আরো ব্যয়বহুল করে তুলছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় এসেছে এ নগদ লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করার। কারণ, লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও ডিজিটাল লেনদেনই হবে ভবিষ্যৎ। লেনদেনে ডিজিটাল মাধ্যম বেশি ব্যবহার করে চীন, ভারত ইতিমধ্যে তা প্রমাণ করেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (কর প্রশাসন) জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ বলেন, আমরা ক্যাশলেসকে উদ্বুদ্ধ করছি। তাই ডিজিটাল লেনদেনে বাধা রিটার্ন দাখিলসহ ভ্যাট/মূসক বিষয়গুলো আসন্ন বাজেটের আলোচনায় উপস্থাপন করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কারণ এসব নিয়ম ক্যাশলেস সোসাইটি গঠনে অনেকটা বাধা হিসেবে কাজ করছে। একই সঙ্গে এনবিআর ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধির জন্য আন্তরিক বলেও উল্লেখ করেন জি এম আবুল কালাম কায়কোবাদ।

বাংলাদেশে এখনো নগদ লেনদেনই প্রধান এবং ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভ্যাট বা কর আরোপ করা হয়। অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশ এখনো ডিজিটাল পেমেন্ট উৎসাহিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমন বাস্তবতায় ডিজিটাল পেমেন্টের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সুপারিশ করেছে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম)। এর (প্রণোদনা) মধ্যে ৩ শতাংশ ব্যবহারকারীদের জন্য এবং ২ শতাংশ ব্যবসায়ীদের জন্য থাকবে।

সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নিতে হলে রিটার্ন জমা দিতে হয়। তবে ব্যক্তিগত ভোক্তা ঋণ নিলে রিটার্ন জমা দিতে হয় না। এর ফলে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার বাড়ছে না। ক্রেডিট কার্ডে ঋণে রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া উচিত। এছাড়া ডিজিটাল লেনদেনে ভ্যাট কাটা হয়। এটাও বন্ধ করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ডিজিটাল লেনদেন এখনও গ্রাহকবান্ধব করা যায়নি বলেই দেশে মাত্র ২৫ লাখ কার্ড রয়েছে, অথচ হওয়া উচিত ১ কোটি।

মাস্টারকার্ডের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, ডিজিটাল পেমেন্ট উৎসাহিত করলে লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়বে, কর ফাঁকি কমবে এবং আর্থিক খাত আরও নিয়ন্ত্রিত হবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল লেনদেন বাড়লে শনাক্তকরণ উপায় জোরদার হবে, যা প্রকারান্তরে রাজস্ব আয় বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।প্রতি বছর ডিজিটাল লেনদেন ও অনলাইন কেনাকাটায় নতুন করে আরোপিত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেন, ডিজিটাল লেনদেনকে উৎসাহিত করতে আগামী তিন থেকে চার বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া উচিত।তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের কার্ড আমদানির ক্ষেত্রে নতুন করে কোনো শুল্ক বা কর আরোপ না করা উচিত। বরং করের চাপ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!