** সদরঘাটের বিক্রমপুর সিটি গার্ডেন মার্কেট, ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজায় বিক্রি হয় বন্ড সুবিধার পণ্য
** চিটাগাং রোডের আশেপাশে বিভিন্ন বাড়িকে অস্থায়ী গোডাউন বানানো হয়, নারায়ণগঞ্জ বন্দর হতে আনা এবং চট্টগ্রাম হতে আসা পণ্য এসব বাড়িতে বন্ডের পণ্য মজুদ করে সুবিধামতো রাতে ভ্যানযোগে বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়
চট্টগ্রামের টেরিবাজারে জাহাজ থেকে খালাস হয় বন্ড সুবিধার কাঁচামাল। সেই কাঁচামাল প্রতিষ্ঠানের বন্ডেড ওয়্যারহাউজে যায় না। সরাসরি চলে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি মার্কেটে। বন্ডেড লাইসেন্সধারী অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রি করে বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গোয়েন্দার অনুসন্ধান বলছে, বন্ড সুবিধার কাপড়, সুতা ও অন্যান্য সামগ্রী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রাকে করে নারায়নগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁঁধারে খালাস হয়। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা ঢাকার কাছে চিটাগাং রোডের কাছে বিভিন্ন বাড়িকে অস্থায়ী গোডাউন বানায়। সেখানে এনে বন্ড সুবিধার কাঁচামাল মজুদ করা হয়। সুবিধামতো সময়ে সেখান থেকে রাজধানীর ইসলামপুর, সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে যায়। যার মাধ্যমে অসাধু বন্ডেড প্রতিষ্ঠান সরকারের শত শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে বিশেষ এই প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে দেওয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এই তথ্য উঠে এসেছে।
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, বন্ডেড সুবিধায় বিভিন্ন প্রকার ফেব্রিক্স বা কাপড় আমদানি করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে—নিট ফেব্রিক্স, ওভেন ফেব্রিক্স, ডেনিম ফেব্রিক্স, মেস ফেব্রিক্স। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার সুতা যেমন—কটন সুতা, পলিস্টার সুতা, নাইলন সুতা, ভলকানাইজড রাবার সুতা; বিভিন্ন প্রকার রং যেমন—প্রিন্টিং ইঙ্ক, সিনথেটিক অর্গানিক ডাইস, সালফার ডাইস, বেস কালার; প্যাকেজিং আইটেম যেমন—কাগজ, ডুপ্লেক্স বোর্ড, পলি প্রোপাইলিন বা পিপি, গামটেপ, এডহেসিভ টেপ, টিস্যু পেপার, আর্টকার্ড, কার্ড বোর্ড; টেক্সটাইল সংক্রান্ত কেমিক্যাল যেমন—এমিনো সিলিকন অয়েল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কস্টিক সোডা, ফিনিশিং এজেন্ট, অ্যাসিটিক অ্যাসিড; লবণ আইটেমের মধ্যে যেমন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম সালফেট, রেসিস্ট সল্ট; বিভিন্ন প্রকার লেবেলিং আইটেম; অন্যান্য পণ্যের মধ্যে রয়েছে—ইলাস্টিক, হ্যাঙ্গার, জিপার, বাটন, ব্লেজার বা জ্যাকেট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে পেডিং ইত্যাদি বন্ড সুবিধায় আমদানি করা হয়।
বন্ডেড সুবিধায় আমদানি করা সুতা ও পোশাক তৈরির কাঁচামাল কিভাবে বন্দর থেকে খোলাবাজারে চলে যায়—তা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন বলছে, বন্ড সুবিধার আওতায় আমদানি করা কাপড়, সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হতে খালাল শেষে ঢাকার আশপাশ যেমন—নারায়ণগঞ্জ, কেরাণীগঞ্জ ও নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় আসলে রাতের অন্ধকারে গাড়ি আনলোড করা হয়। এছাড়াও ঢাকার চিটাগাং রোড়ের কাছাকাছি অনেক বাড়িকে তারা অস্থায়ী গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করে। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধা মতো সময়ে বন্ডের পণ্য চলে যায় রাজধানীর ইসলামপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে। যেসব পয়েন্ট থেকে এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীদের ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত এবং চীন থেকে বন্ডেড সুবিধায় আনা পণ্য প্রথমে চট্টগ্রামের টেরিবাজার নামক স্থানে শিপ বা জাহাজ থেকে আনলোড বা খালাস করা হয়। এসব পণ্য ওয়্যারহাউজে না নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মার্কেটসমূহে পাঠানো হয়। এছাড়াও নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডের আশেপাশে আগে থেকেই অনেক বাড়ি ভাড়া নিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে ভ্যানযোগে সকল পণ্য ঢাকায় পাঠানো হয়। বিভিন্ন কোম্পানির ওয়্যারহাউজ থেকে অবৈধ কাপড় বোঝাই ট্রাক সাধারণত রাত ১২টার পর সরাসরি ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে আসে। এদের মধ্যে সদরঘাটের বিক্রমপুর সিটি গার্ডেন মার্কেট, ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজা অন্যতম।
গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গার্মেন্টেস কাঁচামাল আমদানিকারকরা বেশি পরিমাণ ‘ওয়েস্টেজ’ দেখিয়ে বন্ডেড সুবিধায় প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাপড় আমদানি করে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি শার্ট বা জামার জন্য এক দশমিক ৭৫ ইয়ার্ড কাপড়ের প্রয়োজন হয়। ব্যবসায়ীরা ৩০ শতাংশ ওয়েস্টেজ দেখিয়ে একটি শার্টের জন্য দুই দশমিক ৭৫ ইয়ার্ড কাপড় আমদানি করেন। ফলে বন্ডেড সুবিধায় আমদানি করা অতিরিক্ত কাপড় অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করার সুযোগ তৈরি হয়। আরো দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গার্মেন্টস পণ্য আমদানিকারকরা কাপড়ের স্যাম্পল পরিবর্তন করে অন্য দামি কাপড় নিয়ে আসে। এনবিআরের কর্মকর্তারা আমদানি করা কাপড়ের সাথে স্যাম্পল যথাযথভাবে মিলিয়ে পণ্য খালাস করে না। কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এ সকল অসাধু আমদানিকারকরা বন্ডেড সুবিধায় গার্মেন্টস পণ্য দেশে নিয়ে আসে, যা অর্থনীতিতে কোন ভ্যালু অ্যাড করে না। এছাড়া ওজনে কারচুপি করে এলসিতে উল্লেখ করা পরিমাণের থেকে অতিরিক্ত পণ্য নিয়ে আসে। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠায়। আবার পণ্যের প্রাপ্যতা বা ইউডি এবং ইউপি সংশোধনের মাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করে রপ্তানির জন্য নির্ধারিত পোশাক তৈরির পর অবশিষ্ট কাপড় ও সুতাসহ অন্যান্য পণ্য অবৈধভাবে বিক্রি করে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বন্ডেড সুবিধাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি করা কাঁচামাল দ্বারা উৎপাদিত সব পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব সুরক্ষিত হচ্ছে কিনা—তা নিশ্চিত করতে বন্ডের নিরীক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর নিরীক্ষা করে থাকে। নিরীক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর সব ধরনের ঘোষণা, আমদানি-রপ্তানির সব তথ্য, এলসি, ব্যাংকের ডকুমেন্টসহ যাবতীয় ডকুমেন্ট দিতে হয়। কিন্তু সঠিকভাবে নিরীক্ষা হয় না বিধায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঁচামাল খোলাবাজারে বিক্রির সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বন্ডের সুতার বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থান কাপড়ের মতো সুতা আমদানির ক্ষেত্রেও ওয়েস্টেজ বেশি দেখিয়ে বন্ডেড সুবিধায় অতিরিক্ত সুতা আমদানি করে। এছাড়া অসাধু আমদানিকারকরা কার্টুনে সুতা আনার ক্ষেত্রে কাস্টমসের সাথে যোগসাজশে সুতার গ্রেড পরিবর্তন করে (৩০ কাউন্টের ঘোষণা দিয়ে ৮০ কাউন্টের সুতা) বেশি মূল্যের সুতা নিয়ে আসে। যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করে। আগে বৈধ পথে আনা ভ্যাট চালানের রশিদ ব্যবহার করে বন্ড সুবিধায় আনা বিপুল পরিমাণ কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়ে থাকে বলে গোয়েন্দার তথ্য পেয়েছে। কম মূল্যের সুতার ঘোষণা দিয়ে দামি সুতা আমদানি করায় সুতার অতিরিক্ত মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পাঠানো হয়। এনবিআরের তদারকি না থাকায় অসাধু আমদানিকারকরা এ সুযোগ নিচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক চোরাচালানের সাথে যুক্ত। কিছু অসাধু গার্মেন্টস মালিক নামমাত্র ২০ থকে ২৫টি মেশিন বসিয়ে ভুয়া উৎপাদন দেখিয়ে পোশাক ব্যবসার নামে বন্ড সুবিধার আওতায় কাপড়, সুতা ও অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করছে। এছাড়াও গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারকদের একটি অংশ প্রয়োজনের থেকে বেশি পরিমাণ কাঁচামালের প্রাপ্যতা দেখিয়ে আমদানি করা অতিরিক্ত পণ্য অবৈধভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করছে। আবার একটি বিশেষ চত্র রয়েছে—যারা কমিশনের বিনিময়ে অন্যের বন্ড লাইসেন্স ব্যবহার করে শুল্কমুক্ত সুবিধায় গার্মেন্টেসের কাঁচামাল আমদানি করে প্রতিনিয়ত চোরাকারবারির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও তাদের বন্ড লাইসেন্স বিভিন্ন পন্থায় কার্যকর রেখে সুবিধা আদায় করছে চক্রটি।
বন্ডের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা জড়িত বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। বলা হয়েছে, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কিছু দুর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তার সহায়তায় অসাধু রপ্তানিকারকরা প্রয়োজনের তুলনায় কাঁচামালের প্রাপ্যতা বেশি দেখিয়ে এমনকি বন্ধ কারখানায় রপ্তানির অনুমোদন দেখিয়ে বন্ড লাইসেন্স নিয়ে থাকে। এছাড়াও বন্ড কমিশনারেটের নিরীক্ষা বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সঠিকভাবে নিরীক্ষা না করার কারণে বন্ডেড সুবিধায় আমদানি করা গার্মেন্টস পণ্য ও চোরাচালানের পোশাক খোলাবাজারে বিক্রি বেড়েছে।
বন্ড সুবিধায় আমদানি করা কাপড় ও সুতা খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধে প্রতিবেদনে চারটি সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এনবিআরের অধীনে অটোমেশন সফটওয়্যার চালুর মাধ্যমে বন্ড লাইসেন্সের অধীনে আমদানি করা কাঁচামাল বা এক্সেসরিজ চালানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একই পরিমাণ তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট দেশে রপ্তানি করা হয়েছে কিনা—তা পর্যবেক্ষণ করা এবং অনিয়মের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সম্প্রতি বন্ড অটোমেশন পুরোপুরি চালু হয়েছে। এছাড়া বন্ড লাইসেন্সধারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ারহাউজ আকস্মিক পরিদর্শন এবং তিনমান অন্তর অন্তর নিরীক্ষা করা; এলসি খোলার সময় কাপড়ের স্যাম্পলযুক্ত করতে বাধ্য করা। এলসিতে উল্লিখিত পণ্যের সাথে আমদানি করা পণ্যের গ্রেড যাচাই করার জন্য অটোমেটেড মেশিন ব্যবহার করা এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যাচাই করা; গার্মেন্টস পণ্য উৎপাদনের জন্য কি পরিমাণ সুতা এবং কাপড়সহ অন্যান্য এক্সেসরিজের প্রয়োজন—তা নিরূপণের জন্য এনবিআর, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ এর সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা। প্রয়োজনে কমিটি এই সংক্রান্ত সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করবে।