জুলাই অভ্যুত্থানে ৪১ পুলিশ গ্রেপ্তার,আসামি ১০৫৯

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলি করে মানুষের হতাহতের ঘটনায় ১ হাজার ৫৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৪১ পুলিশ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ-আল মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমান, উপমহাপরিদর্শক মোল্যাহ নজরুল ইসলাম এবং চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম সহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা রয়েছেন।

অবশ্য সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের মতো বিতর্কিত অনেক কর্মকর্তা পলাতক। কেউ কেউ পালিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে গুলি ও হত্যার ঘটনায় বাহিনীর ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। হত্যার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার দাবি ওঠে। স্বজন হারানো ও ভুক্তভোগীদের পরিবারের করা মামলায় মোট আসামি ১ হাজার ৫৯ পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে সাবেক আইজিপি ৫, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ৪১, সাবেক ডিআইজি ১২, বর্তমান ডিআইজি ১২, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি ২, বর্তমান অতিরিক্ত ডিআইজি ৪২, সাবেক এসপি ৩, বর্তমান এসপি ৫৯, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ৫৬, সহকারী পুলিশ সুপার ২১, পরিদর্শক ১৬৮, এবং বাকি ৬৩৮ জন এসআই, এএসআই, নায়েক ও কনস্টেবল।

prothomalo bangla 2025 02 17 rlu2p16e Screensho
মোট কয়টি মামলায় পুলিশ সদস্যরা আসামি, তা সদর দপ্তর আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তবে সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যার ঘটনায় ৬৫৬টি মামলা হয়েছে। আহত হওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭৩৭টি। হতাহত মিলিয়ে মোট মামলা ১ হাজার ৩৯৩টি।

বর্তমানে পুলিশের দায়িত্বশীল পদে থাকা একাধিক কর্মকর্তার মতে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দেওয়া ও গুলি করার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিছু ক্ষেত্রে আসামি করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। এসব যাচাই-বাছাই করেই পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যাঁরা নির্দোষ, তাঁরা হয়রানির শিকার হবেন না।

আইজিপি বাহারুল আলম গত ডিসেম্বরে বলেছিলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হওয়া মামলা তদারকিতে পুলিশের আট রেঞ্জের প্রতিটিতে একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটি মামলাগুলো তত্ত্বাবধান করবে। সাবেক ও বর্তমান অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে মামলাগুলো তদন্ত করা হবে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলায় আরও অনেকের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের আসামি করা হয়েছে, তাই এসব মামলার তদন্তের ওপর হত্যাকাণ্ডে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচার নির্ভর করছে। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনার মামলাগুলো পুলিশ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে। তদন্তে যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে। স্বজন হারানো পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে মামলার পাশাপাশি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলছে। সেখানে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎকালীন ১৮ কর্মকর্তাকে।

যাঁরা গ্রেপ্তার

গ্রেপ্তার হওয়া পুলিশের তৎকালীন কর্মকর্তাদের মধ্যে আরও রয়েছেন ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা, পুলিশ সুপার (এসপি) তানভীর সালেহীন, মহিউদ্দিন ফারুকী, আবদুল মান্নান, এস এম তানভীর আরাফাত, আসাদুজ্জামান, মো. আবদুল্লাহিল কাফী, জুয়েল রানা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম, খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. সাদেক কাওছার দস্তগীর, বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার এম এম মইনুল ইসলাম, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার ইফতেখার মাহমুদ, মো. তানজিল আহমেদ, ডিএমপির বাড্ডা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।

মামলা বেশি কার বিরুদ্ধে

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে, সংখ্যাটি ১৭৪। এরপরই রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, মামলার সংখ্যা ১৫৯। এ ছাড়া সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের বিরুদ্ধে ২৩, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ১১, হাসান মাহমুদ খন্দকারের বিরুদ্ধে ৭ ও জাবেদ পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে ২টি মামলা হয়েছে।সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৪৬, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ১১৮, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১৬, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ১২৮ ও অতিরিক্ত ডিআইজি এস এম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়েছে।

ডিএমপির উপকমিশনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ওয়ারী বিভাগের তৎকালীন উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের বিরুদ্ধে, যার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সরকার পতনের পর ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করার বিষয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে কথা বলছেন ইকবাল। মুঠোফোনে একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ এ সময় সেখানে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকেন্দ্রিক মামলার তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। যাঁরা নির্দোষ, তাঁদের মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে হবে এবং যাঁদের অপরাধে সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিতে হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!