জুলাই অভ্যুত্থানে ১৩৩ শিশু শহীদ

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে অন্তত ১৩৩ শিশু শহীদ হয়েছে। এদের মধ্যে স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত শিশুরাও রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, শহীদদের মধ্যে ১১৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়।

শহীদ শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিল ৪ বছর বয়সী আবদুল আহাদ। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগে নিজ বাসার বারান্দায় গত বছরের ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয় সে। পরদিন ২০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। আহাদের মতো বাসায় থেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে আরও তিন শিশু—মিরপুরের সাফকাত সামির (১০), উত্তরার নাঈমা সুলতানা (১৫) এবং নারায়ণগঞ্জের রিয়া গোপ (৬)।

গণ–অভ্যুত্থানে শিশু মৃত্যুর প্রথম ঘটনা ঘটে ১৭ জুলাই। সেদিন ভোলা থেকে ঢাকায় খালাতো ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে আসা মো. সিয়াম (১৫) যাত্রাবাড়ীতে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সিয়াম অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার খালাতো ভাই মো. রাসেল হোসেন জানান, ঘটনার সময় সিয়াম তাদের সঙ্গেই ছিল। এখানে ‘শিশু’ বলতে ১৮ বছরের কম বয়সীদের বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী সবাই শিশু হিসেবে গণ্য।

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে শহীদদের সরকারি তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁদের মধ্যে ৮১০ জনের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ১৫ জুন থেকে ১৫ জুলাই পর্যন্ত এক মাস ধরে এই ৮১০ শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা। তাঁদের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ কাজে অংশ নেন ৪৭ জন প্রতিবেদক ও প্রতিনিধি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অনুযায়ী, ২ আগস্ট পর্যন্ত শহীদদের তালিকায় ৮৪৪ জনের নাম ছিল। তবে গতকাল রোববার (৩ আগস্ট) রাত ৯টার দিকে প্রকাশিত নতুন গেজেটে ৮ জনের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। এতে শহীদ সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ৮৩৬ জনে। বাতিল হওয়া আটজনের মধ্যে এক শিশুসহ চারজনের নাম তালিকায় দুবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাকি চারজন সরাসরি জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদ শিশুদের মধ্যে ৯১ জন ছিল স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। এছাড়া ৪১ জন শিশু অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন খাতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত। এদের বাইরে সবচেয়ে কম বয়সী শহীদ ছিল চার বছর বয়সী আহাদ।

সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে আবুল হাসান বলেন, রায়েরবাগের একটি ১১ তলা ভবনের ৮ তলায় ভাড়া থাকতেন তাঁরা। সেদিন ছিল শুক্রবার, তাই তিনি বাসাতেই ছিলেন। আহাদ ঘরের ভেতরে খেলছিল। হঠাৎ নিচ থেকে বিকট শব্দ শুনে তিনি, তাঁর স্ত্রী ও আহাদ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান। আহাদ দাঁড়িয়েছিল মাঝখানে। তিনি বলেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থনে হেলমেট পরা অস্ত্রধারীরা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল এবং হাত উঁচিয়ে উপরেও গুলি ছুড়ছিল। ওই সময় একটি গুলি আহাদের ডান চোখে লাগে, যা চোখ ভেদ করে মাথায় গিয়ে বিদ্ধ হয়। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষণ চুপ করে যান আবুল হাসান। এরপর ভেঙে পড়ে বলেন, ছেলেকে ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ (যার কার্যক্রম বর্তমানে নিষিদ্ধ) এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বহু নেতা-কর্মী হামলা ও গুলি চালিয়েছিলেন। এমনকি গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি ছুড়েছেন, যাতে আরও অনেক মানুষ শহীদ হন। উত্তরার জাবির ইব্রাহিম (৬) তেমনই একজন শিশু শহীদ। মা–বাবার সঙ্গে বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদ শিশুদের মধ্যে চারজন মেয়ে রয়েছে। তারা হলেন রিয়া গোপ (৬), নাঈমা সুলতানা (১৫), রিতা আক্তার (১৭) ও নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। রিয়া বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়, আর নাঈমা বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। রিতা ও নাফিসা জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং দুজনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে।

গত বছরের ১৯ জুলাই বিকেলে উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকানো কাপড় আনতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় নাঈমা। সে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। নাঈমার মা আইনুন নাহার বলেন, নিজের বাসায় এভাবে অনিরাপদ হতে হবে, ভাবিনি। এখন সবকিছুতেই ভয় কাজ করছে… নাঈমা চিকিৎসক হতে চেয়েছিল। সব শেষ হয়ে গেল। বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদ শিশুদের মধ্যে ৯১ জন শিক্ষার্থী, যা মোট শহীদ শিশুদের ৬৮ শতাংশ। বাকি শিশুরা বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত ছিল—কেউ দোকানের কর্মী, কেউ পোশাক কারখানার শ্রমিক, কেউ নির্মাণকর্মী, কেউ হকার, আবার কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন।

শহীদ শিশুদের মধ্যে একজন ইমাম হাসান তায়িম ভূঁইয়া (১৭) পুলিশের নৃশংসতায় মারা যান। ঘটনাটি ঘটে ২০ জুলাই, যাত্রাবাড়ীর কাজলা পদচারী-সেতুর কাছে, যেখানে পুলিশ একের পর এক গুলি চালায়। এই ঘটনার একটি ভিডিও তখন ভাইরাল হয়। তায়িম নারায়ণগঞ্জের সরকারি আদমজীনগর এমডব্লিউ কলেজের ছাত্র ছিলেন। তার বড় ভাই রবিউল আউয়াল জানান, ‘তায়িমের শোকে বাবা স্ট্রোক করেছেন এবং এক হাতের ৭০ শতাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত। মা সব সময় বিষণ্ন থাকেন। আমরা তায়িমের হত্যার ন্যায়বিচার চাই।’

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদ শিশুদের মধ্যে চারজন মেয়ে রয়েছে। তারা হলেন রিয়া গোপ (৬), নাঈমা সুলতানা (১৫), রিতা আক্তার (১৭) ও নাফিসা হোসেন মারওয়া (১৭)। রিয়া বাসার ছাদে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়, আর নাঈমা বাসার বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। রিতা ও নাফিসা জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল এবং দুজনেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়।

৮৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ

গুলিবিদ্ধ আস সাবুরের (১৪) অর্ধপোড়া লাশ পরিবারের কাছে পৌঁছেছিল। সে ঢাকার আশুলিয়ায় শাহীন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সাবুরের বড় ভাই রিজওয়ানুল ইসলাম জানান, ৫ আগস্ট সকাল থেকে সাবুর আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। দুপুর ১২টার দিকে সাবুর তাকে ফোন করে জানায়, থানা থেকে প্রচণ্ড গুলি চালানো হচ্ছে। এই খবর পেয়ে রিজওয়ানুল তাকে বাড়ি ফিরে আসার কথা বলে, তবে সাবুর বাড়ি ফেরেনি। পরদিন ৬ আগস্ট তাদের হাতে সাবুরের লাশ আসে। রিজওয়ানুল বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, যা এখন বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা চাই, হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি হোক।

বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শহীদ হওয়া শিশুদের ৮৮ শতাংশ গুলিবিদ্ধ ছিল।

গণ–অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া কয়েকজন শিশুর নাম এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। তাদের মধ্যে একজন হলেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শাহারিয়ার খান আনাস (১৬)। ৫ আগস্ট বাড়িতে চিঠি রেখে সে বিক্ষোভে যোগ দেয়। চিঠিতে লিখেছিল, ‘মা, আমি মিছিলে যাচ্ছি। নিজের ভয়ের সামনে আর থাকতে পারলাম না। মৃত্যুর ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকা থেকে ভালো সংগ্রামে নেমে গুলি খেয়ে বীরের মতো মরাটাই শ্রেষ্ঠ।’ ওই দিন রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলিতে আনাসের মৃত্যু হয়।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া (১৭) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ফারহান ফাইয়াজ’ নামে পরিচিত ছিল। ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুর একদিন আগে নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ইংরেজিতে তিনি লিখেছিলেন, যার বাংলা অনুবাদ হলো, ‘একদিন পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। এমন জীবন গড়ো, যাতে মৃত্যুর পর মানুষ তোমাকে মনে রাখে।’

‘এটি একটি গণহত্যা’

জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, শিশু ও কিশোরসহ নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করা কোনো অন্যায় নয়, এটা গণহত্যা ছাড়া কিছুই হতে পারে না। যেভাবে নিজের দেশের শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, তা জাতির জন্য বড় কলঙ্কের বিষয়। এটি দেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। তবে গর্বের বিষয় হলো, আন্দোলনে সব বয়সী মানুষ—শিশু ও কিশোরসহ—স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!