২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সঞ্চয়পত্র (এনএসসি) বিক্রি ৪১ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ মাসে নিট বিক্রি হয়েছে ১,২৯৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের ২,১৮৭ কোটি টাকার তুলনায় কম। তবে পরিমাণ কমলেও আগের তিন বছরের মতো এবার নিট বিক্রি ঋণাত্মক হয়নি। এর পেছনে প্রধান কারণ সরকার ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া ঋণ শোধে জোর দেওয়া। পাশাপাশি অনেক গ্রাহক এখন সঞ্চয়পত্র ছেড়ে ব্যাংক ও বন্ডে বিনিয়োগকে বেশি লাভজনক মনে করছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ। টানা ৩৫ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরে থাকার পর জুলাইয়ে সাধারণ মূল্যস্ফীতি সামান্য কমে ৮.৫ শতাংশে নেমেছে। তবুও এটি পরিবারগুলোর বাজেটে চাপ সৃষ্টি করার পর্যায়ে রয়েছে। এই অবস্থায় অনেক ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীর পক্ষে নতুন বিনিয়োগ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সময় ব্যাংকের আমানতে সুদের হার বাড়ায় অনেকে ব্যাংকের দিকে ঝুঁকছেন, কারণ সঞ্চয়পত্রের তুলনায় ব্যাংক আমানতে সুবিধা ও নমনীয়তা বেশি।
সরকার ধীরে ধীরে সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে, কারণ সঞ্চয়পত্রের সুদহার ব্যাংক ঋণ ও ট্রেজারি বন্ডের তুলনায় বেশি। তাই নতুন সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিবর্তে পুরনো ঋণ শোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। গত তিন অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে ঋণাত্মক বিক্রির প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থাৎ মেয়াদোত্তীর্ণ সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ নতুন বিনিয়োগের চেয়ে বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রেকর্ড ২১ হাজার ১২৪ কোটি টাকার ঋণাত্মক বিক্রি হয়েছে, ২০২২-২৩ সালে তিন হাজার ২৯৫ কোটি এবং ২০২৪-২৫ সালে ছয় হাজার ৬৩ কোটি টাকা।
ব্যাংকাররা বলছেন, ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে সঞ্চয়কারীরা পুরনো সঞ্চয়পত্র ভেঙে নিচ্ছেন অথচ নতুন করে কিনছেন না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হয়ে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে চলে যাচ্ছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ১-২ শতাংশ কমানো হয়। পাশাপাশি পাঁচ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে জাতীয় পরিচয়পত্র ও আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণ বাধ্যতামূলক করা হয়। এতে অনেক সচ্ছল বিনিয়োগকারী নিরুৎসাহ হন, যাঁরা আগে বিভিন্ন নামে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করতেন।
একসময় বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র ছিল সরকারের বড় ভরসা। ২০২১-২২ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের নিট ঋণ ছিল ১৯ হাজার ৯১৫ কোটি টাকা, ২০২০-২১ সালে ৪১ হাজার ৯৫৯ কোটি, ২০১৯-২০ সালে ১৪ হাজার ৪২৮ কোটি, ২০১৮-১৯ সালে ৪৯ হাজার ৯৩৯ কোটি এবং ২০১৬-১৭ সালে ৫২ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা। বর্তমানে টানা তিন বছরের নেতিবাচক ধারা সেই সময়ের সম্পূর্ণ উল্টোচিত্র তুলে ধরছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকারের ব্যাংক খাত থেকে নিট ঋণ কমে ৭২,৩৭২ কোটি টাকা হয়েছে, যা আগের বছরের ৯৪,২৮২ কোটি টাকার তুলনায় কম। তবে শুধু বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে এক লাখ ৩৬,৩৬৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সরকার এই টাকা দিয়ে আগের ঋণ পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, ফলে ব্যাংক খাতজুড়ে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। এ সময় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগের বড় অংশ ব্যাংক ও বিল-বন্ডে স্থানান্তরিত হচ্ছে। জুলাই শেষে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়িয়েছে ১১.১৬ শতাংশ, আর দীর্ঘমেয়াদি বন্ডে সুদহার বেড়ে ১২.৮১ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া এই বিনিয়োগে ব্যাংক বা সঞ্চয়পত্রের মতো কোনো কর দিতে হয় না, ঊর্ধ্বসীমা নেই এবং চাইলে অন্যের কাছে বিক্রিও করা যায়।
সঞ্চয়পত্রে সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য বিনিয়োগ করতে হয়। মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙালে মুনাফার সর্বনিম্ন হার হয় ৭.৭১ শতাংশ। মেয়াদ এবং টাকার পরিমাণ অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১১.৭৬ শতাংশ মুনাফা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে চার ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে সুদহার ১১.৫২ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১.৭৬ শতাংশ, পাঁচ বছর মেয়াদি মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১.২৮ শতাংশ এবং তিন বছর মেয়াদি ও তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১.৪ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদ আর্থিক খাতের জন্য ক্ষতিকর। বিশেষ করে বন্ড মার্কেটের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ বেশি সুদের কারণে বেসরকারি কোম্পানিগুলো বন্ড ছাড়তে আগ্রহী হচ্ছে না। বন্ড মার্কেট উন্নত না হলে আর্থিক খাতও পূর্ণ বিকশিত হবে না। তাদের মতে, সরকারের উচিত অবসরপ্রাপ্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও পেনশন সুবিধা বাড়ানো।
** সঞ্চয়পত্র কিনতে পিএসআর’র ঝামেলা শেষ
** ‘সঞ্চয়পত্রের মুনাফা বাড়ালে ব্যাংকে কেউ টাকা রাখবে না’
** সঞ্চয়পত্র-এফডিআরে ‘পিএসআর’র শর্ত শিথিল হচ্ছে
** বিক্রির চেয়ে পরিশোধ বেশি, ধুঁকছে সঞ্চয়পত্র
** তিন মাসে ২৫ হাজার সঞ্চয়পত্র ভেঙ্গেছে মানুষ
** নগদ ও সঞ্চয়পত্রের বিরোধে আটকে অনুদান
** সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বেড়েছে ১২.৫৫%
** শহিদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্র কেনায় ছাড় দিলো এনবিআর
** আয়করের ১২ এসআরও বাতিল, কি কি সুবিধা ছিলো?