২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ছিল মন্থর। বিশেষ করে দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব পড়ার ফলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৭৮ শতাংশে নেমে আসে। যদিও প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের ওপর। জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনও অর্থনীতির গতি হ্রাসে ভূমিকা রাখে, যার কারণে পুরো বছরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ধীরগতি দেখা যায়।
এরপরও সাময়িক হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে প্রবৃদ্ধি আকস্মিকভাবে বেড়ে পাঁচ দশমিক ৮২ শতাংশ দেখানো হয়, যদিও প্রকৃত হিসাব প্রকাশের পর চূড়ান্ত প্রবৃদ্ধি ৪.২২ শতাংশে নেমে আসে। এই পার্থক্যটি মূলত জিডিপির হিসাবে বড় ধরনের ছলচাতুরির ফলস্বরূপ ঘটে, যা পরে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ধরা পড়ে।
এ হিসাবে গত অর্থবছর সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এক দশমিক ৬০ শতাংশীয় পয়েন্ট বা প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি দেখানো হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, গত অর্থবছর সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল, যা চূড়ান্ত হিসাবে কমে গেছে। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি বলেন,২০২৩-২৪ অর্থবছরের জিডিপির চূড়ান্ত হিসাব প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে সাময়িক হিসাবে ৫০ হাজার ৪৮০ বিলিয়ন টাকার আকার দেখানো হয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত হিসাব ৫০ হাজার ২৭ বিলিয়ন টাকা। এতে ৪৫৩ বিলিয়ন টাকা বেশি দেখানো হয়েছিল। গত অর্থবছরের জিডিপির আকার সাময়িক হিসাবে ৪৫৯ বিলিয়ন ডলার দেখানো হলেও, চূড়ান্ত হিসাবে তা ৪৫০ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাময়িক হিসাবে মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৭৮৪ ডলার দেখানো হয়েছিল, যা চূড়ান্ত হিসাবে কমে দুই হাজার ৭৩৮ ডলারে দাঁড়িয়েছে, অর্থাৎ ৪৬ ডলার বেশি দেখানো হয়েছিল। আগের বছরগুলোতে মাথাপিছু আয় ছিল যথাক্রমে দুই হাজার ৭৪৯ ডলার (২০২২-২৩), দুই হাজার ৭৯৩ ডলার (২০২১-২২), এবং দুই হাজার ৫৯১ ডলার (২০২০-২১)। ২০২১-২২ পর থেকে টানা দুই বছর কমেছে মাথাপিছু আয়, যদিও সাময়িক হিসাবে তা বাড়ানো হয়েছিল।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল সাময়িক হিসাবে ছয় দশমিক ০৩ শতাংশ। তবে চূড়ান্ত হিসাবে তা কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আর গত অর্থবছরের জন্য বাজেট ঘোষণার সময় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সাড়ে সাত শতাংশ। তবে নির্বাচনের বছর স্বাভাবিকভাবেই অর্থনীতির গতি হ্রাস পায় বলে প্রবৃদ্ধি বাড়ার কোনো সুযোগ নেই বলে আগেই বলেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তথ্যে ছলচাতুরি করে ২০২৩-২৪ অর্থবছর সাময়িক হিসাবে বাড়তি প্রবৃদ্ধি দেখায় হাসিনা সরকার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিবিএসের সাময়িক হিসাবে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি কমে ৩.২১% হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিল ৩.৩৭%। অর্থাৎ, প্রবৃদ্ধি কমেছে ০.১৬%। একইভাবে, শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ৬.৬৬% হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরে ছিল ৮.৩৭%। এতে ১.৭১% কমেছে এবং এটি ছিল চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি।
অন্যদিকে গত অর্থবছর সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি মাত্র শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ বাড়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছর এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল পাঁচ দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছর সাময়িক হিসাবে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৮০ শতাংশ। কৃষি ও শিল্পে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার পরও সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাময়িক হিসাবে কীভাবে বাড়ল তার কোনো ব্যাখ্যা বিবিএসের প্রতিবেদনে তখন দেয়া হয়নি।
এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছর প্রথম দুই প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাওয়ার পরও সাময়িক হিসাবে এ খাতের প্রবৃদ্ধি কেন বাড়ল তারও ব্যাখ্যা ছিল না। এর আগে প্রথম প্রান্তিকে সেবা খাতে তিন দশমিক ৭৩ ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে তিন দশমিক ০৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এ থেকেই প্রবৃদ্ধির ছলচাতুরি সামনে চলে আসে।
প্রসঙ্গত,২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে চলমান ডলার সংকট, আমদানিতে ধস, এবং সরকারের বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমবে বলে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছিল। তবে বিবিএসের সাময়িক প্রতিবেদনে উল্টো চিত্র দেখা গিয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত হিসাব অনুযায়ী প্রকৃত চিত্রটি স্পষ্ট হয়েছে।