সোনালী ব্যাংক থেকে জাল নথিপত্রের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের ঋণ অনুমোদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এসকে সুর) জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। আলোচিত হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারির এক মামলায় সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে, এসকে সুর হলমার্কের মালিক তানভীরের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন ও ঋণ মঞ্জুরে প্রভাব বিস্তার করেছেন।
সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক খাতে এই আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন এসকে সুর। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, সব ব্যাংককে নিয়মিত পরিদর্শন ও অডিট প্রতিবেদন দাখিল করতে হয়। কিন্তু ঋণ জালিয়াতির সময় এসকে সুর সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন করপোরেট শাখায় পরিদর্শন ও অডিটের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করেন। তিনি তাদের নিয়মিত পরিদর্শন ও অডিট প্রতিবেদন দিতে বাধা দেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িতদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করেন।
সম্পদ বিবরণী না দেওয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৪ জানুয়ারি এসকে সুরকে গ্রেফতার করে। পরে সিআইডির আবেদনের পর ২৭ জানুয়ারি হলমার্কের বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানায় ৭ বছর আগে দুদকের করা এক মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলাটি সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তদন্ত করছে। তদন্ত কর্মকর্তা, সিআইডির পরিদর্শক ছায়েদুর রহমানের আবেদনের ভিত্তিতে এসকে সুরকে মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি সিআইডি তাকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। বর্তমান ও সাবেক ব্যাংকারদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে এসকে সুর নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন। তার সময়েই বড় পরিসরে ঋণ ছাড় ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। যদিও তিনি গভর্নর ছিলেন না, তবু অলিখিতভাবে গভর্নরের ভূমিকা পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ড. আতিউর রহমান গভর্নর হলেও মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করতেন এসকে সুর চৌধুরী।
সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) বাসির উদ্দিন বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুদকের করা একটি মামলার তদন্ত চলছে। এ মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত যাচাই করা হচ্ছে। মামলাটির তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, হলমার্ক গ্রুপের কর্মকর্তা ছিলেন তুষার আহমেদ ও আসলাম উদ্দিন। তুষার আহমেদ হলমার্ক গ্রুপের জিএম (কমার্শিয়াল) পদে কর্মরত থাকাকালীন সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা বেতন পেতেন, যা রেজিস্ট্রারের রেকর্ডেও প্রতিফলিত হয়েছে।
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে তুষার আহমেদ ও আসলাম উদ্দিনের যৌথ নামে, আসলাম উদ্দিনের একক নামে এবং তুষার আহমেদের একক নামে ঢাকা ব্যাংকের প্লাটিনাম হিসাব পরিচালিত হয়। এসব হিসাবের মাধ্যমে তুষার আহমেদ, মোহাম্মদ আসলাম উদ্দিন ও সুমন ভূঁইয়া ১৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের মাধ্যমে হস্তান্তর ও স্থানান্তর করেন। তারা লেয়ারিং পদ্ধতি ব্যবহার করে অর্থের অবৈধ উৎস গোপন করেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
নথিপত্র জাল করে সোনালী ব্যাংক থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাতের মামলায় গত বছরের ১৯ মার্চ আদালত হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।দুদকের করা মামলায় অভিযোগ করা হয়, ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিলের মধ্যে হলমার্ক গ্রুপের ১১টি কোম্পানির নামে ভুয়া ঋণপত্র (এলসি) খুলে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।