জালিয়াতির ‘ষ্পোর্টস কারের’ দাম মাত্র ৬০ হাজার টাকা!

** অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দূতাবাস থেকে নামমাত্র মূল্যে গাড়ি কিনে, সেই গাড়ি দেখিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া বিলাসবহুল গাড়ির নিবন্ধন নেন, যাতে লুকানো হয় চেসিস নাম্বার, দেয়া হয় ভুয়া কাগজপত্র
** দুই দরজার ষ্পোর্টস কার সার্ভিস সেন্টারে চার দরজা করতে এনে আটক হয়েছে
** বিআরটিএ-তে নিশান সেফিরো নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার’

নিলামে চায়না দূতাবাসের ‘নিশান সেফিরো’ ব্রান্ডের গাড়ি কিনলেন মাত্র ৬০ হাজার টাকায়। কিন্তু নামমাত্র কেনা এই গাড়ি হয়ে গেলো প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা দামের ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার! সেফিরো ব্রান্ডের গাড়ির চেসিস নাম্বার অবৈধভাবে বসানো হয়েছে নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার ব্রান্ডের গাড়িতে। জালিয়াতি এখানেই শেষ নয়। বিআরটিএ-তে ‘নিশান সেফিরোর’ নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু বিআরটিএ নিবন্ধন দিয়েছে ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার’ হিসেবে। আবার নিশান সেফিরো গাড়ি আমদানি করেছে চায়না দূতাবাস। কিন্তু একই গাড়ি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফ্রান্স দূতাবাসের নামে ‘ট্যাক্স টোকেন’ নেয়া হয়েছে।
GTR
আবার চায়না দূতাবাস নিবন্ধনের সময় গাড়ির রং উল্লেখ ছিলো সাদা। কিন্তু জালিয়াত চক্র নিবন্ধনের সময় গাড়ির রং হয়ে গেলো কালো। দূতাবাস থেকে নিলামে নামমাত্র দামে কেনা গাড়ি দেখিয়ে, অবৈধভাবে বা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে আমদানি করা গাড়ি ব্যবহারের চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সফল হননি। কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এমন জালিয়াতি করা একটি ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার’ গাড়ি আটক করেছে। আটকের পর ‘দূতাবাসের’ নিলামে বিক্রি করা গাড়ির জালিয়াতি সামনে এসেছে।

গাড়ি ব্যবসায়ীরা বলছেন, একাধিক চক্র দূতাবাস থেকে নিলামে নামমাত্র মূল্যে গাড়ি কেনেন। আবার কখনো পার্টস ঘোষণায়, কখনো মিথ্যা ঘোষণায় বিলাসবহুল গাড়ি আমদানি করেন। পরে দূতাবাস থেকে নামমাত্র মূল্যে কেনা গাড়ির চেসিস নাম্বার ও ভুয়া মডেল, সিসি নাম্বার দিয়ে নিবন্ধন নেন। এতে বিআরটিএ এর এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা সহায়তা করেন। এনবিআর ও বিআরটিএ এই বিষয়ে সচেতন হলে শুল্ককর ফাঁকি ও ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নিবন্ধন নেয়া গাড়ির পরিমাণ কমে যাবে। তথ্যমতে, ষ্পোর্টস গাড়ির দুনিয়ায় ‘নিশান জি-টিআর’ ভালোই নাম রয়েছে। জাপানিজ এই গাড়িটির মূল্য বাংলাদেশে শুল্ককরসহ প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা।
Nissan GTR 1

কাস্টমস গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, কাস্টমস গোয়েন্দার মহাপরিচালক তথ্য পান যে, রাজধানীর বারিধারার একটি গাড়ির সার্ভিস সেন্টার বা ওয়ার্কসপে একটি ‘সেডান কারের’ চেসিস ও ইঞ্জিন নাম্বার ব্যবহার করে একটি ‘ষ্পোর্টস কার’ সংযোজন করা হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে ৮ ডিসেম্বর বিকেলে কাস্টমস গোয়েন্দার একটি দল বারিধারা ভাটারা জগন্নাথপুর এলাকার কন্টিন্টোল ওয়ার্কস লিমিটেড নামে একটি গাড়ির সার্ভিসিং সেন্টারে অভিযান পরিচালনা করেন। এসময় সেখান থেকে নাম্বারপ্লেট বিহীন একটি ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার’ গাড়িটি আটক করা হয়। গাড়ির চেসিস নাম্বার হলো-জেএনআইসিসিইউএ৩৩জেড০-১৭০৪৮০। মূলত আটক করা গাড়িটির দুই দরজা। গাড়িটির চার দরজা করার জন্য সার্ভিস সেন্টারে আনা হয়েছে, যাতে রাস্তায় চলার সময় ‘ষ্পোর্টস কার’ হিসেবে কেউ বুঝতে না পারেন।

সার্ভিস সেন্টারের কর্মচারীরা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানান, গাড়িটি রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার মারজান অটো নামে একটি প্রতিষ্ঠান ওই সেন্টারে দিয়ে গেছেন। পরবর্তীতে মারজান অটো কর্মকর্তারা সার্ভিস সেন্টারে হাজির হন এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কিছু কাগজপত্র দেন। যাতে দেখা গেছে, কৌশিক আহমেদ নামের এক ব্যক্তি এনবিআরের অনুমোদন সাপেক্ষে চায়না দূতাবাস থেকে ২০২২ সালে মাত্র ৬০ হাজার টাকায় কিনেছেন। তবে মারজান অটো যে গাড়িটির কথা বলেছেন, তা হলো ‘নিশান সেফিরো’। কিন্তু আটক করা গাড়িটি হলো ‘নিশান ষ্পোর্টস কার’। মারজান অটোর কর্মকর্তারা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, তারা কৌশিক আহমেদ এর কাছ থেকে গাড়িটি কিনেছেন।
Nissan GTR 3
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটক করা গাড়িটি হলো দুই দরজার নিশান ষ্পোর্টস কার, যাতে দূতাবাস হতে নিলামে কেনা নিশান সেফিরো সেডান কার এর চেসিস নাম্বার অবৈধভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর প্রতিটি গাড়ির চেসিস নাম্বার স্বতন্ত্র হয়ে থাকে। আর মারজান অটোর দাখিল করা কাগজপত্রে ব্যাপক গরমিল রয়েছে। গাড়িটি আমদানির সময় ২০০২ সাল হলেও (বিল অব এন্ট্রি সি-০৫৩৮৩, তারিখ-০১.০৮.২০২২) এর উৎপাদন সাল দেখানো হয়েছে ২০০৮। উৎপাদনের আগে আমদানি কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া, একই গাড়িটিকে আবার বাংলাদেশে অবস্থিত ফ্রান্স দূতাবাসের বিপরীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ‘ট্যাক্স টোকেন’ সনদ দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের একটি চিঠির কপি মারজান অটো গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দিয়েছেন। এতে ষ্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, আটক করা গাড়িটির সঙ্গে চায়না দূতাবাসের নিলামে বিক্রি করা গাড়ির মিল নেই। ষ্পোর্টস কারটি হয়ত পার্টস আকারে, না হয় মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছে। যাতে বিপুল পরিমাণ শুল্ককর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মারজান অটো বিআরটিএ এর থেকে নিবন্ধনের জন্য যে আবেদন জমা দিয়েছে, তাতে গাড়ির ব্রান্ড দেখানো হয়েছে নিশান সেফিরো। কিন্তু বিআরটিএ এই গাড়িটিকে ষ্পোর্টস কার হিসেবে কিভাবে নিবন্ধন দিয়েছেন-তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা নিশ্চিত যে, চায়না দূতাবাসের কাছ থেকে নিশান সেফিরো গাড়িটি নিলামে কেনা হলেও পরবর্তীতে মিথ্যা ঘোষণায় বা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ষ্পোর্টস কার গাড়িটি এনে বা সংযোজন করে, তাতে অবৈধভাবে সেফিরো গাড়ির চেসিস নাম্বার ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে। এবং এতে নিশ্চিতভাবে শুল্ক করাদি ফাঁকি হয়েছে। এই বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা অনুসন্ধান করছে।

অপরদিকে, বিআরটিএ এর নিবন্ধন অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবস্থিত চায়না দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার (জু জিয়াং) নামে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট গাড়িটি নিবন্ধন দেওয়া হয়। যার নিবন্ধন নম্বর দ ২৮-১৫৪। ২০২০ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত নিবন্ধনের মেয়াদ ছিলো। নিবন্ধনের তথ্যে বলা হয়েছে, গাড়ির শ্রেণি হলো নিশান সেফিরো। গাড়ির বডির ধরন হলো সেডান কারের মতো। গাড়িটির প্রস্তুতকারক জাপানের নিশান কোম্পানি। সাদা রঙের ২০০৮ সালে তৈরি গাড়ির সিসি হলো ৩৮০০। অকটেন জ্বালানিতে চলা গাড়িটির সিলিন্ডার সংখ্যা ৬। ৫ আসন সংখ্যার গাড়িটির চেসিস নংজেএনআইসিসিইউএ৩৩জেড০-১৭০৪৮০ ও ইঞ্জিন নং ভি কিউ ৩০-৫৩৬২৬২।

অন্যদিকে, তেজগাঁও শিল্প এলাকার মারজান অটোস ‘নিশান সেফিরো’ গাড়িটি রেজিস্ট্রেশনের জন্য বিআরটিতে যে আবেদন করেছে, তাতে চায়না দূতাবাসের কর্মকর্তার নিবন্ধন নেওয়ার সব তথ্যের সঙ্গে মিল রয়েছে। চায়না দূতাবাস গাড়িটির রঙ উল্লেখ করেছে সাদা। আর মারজান অটোস উল্লেখ করেছে গাড়িটির রঙ হলো কালো। তবে মারজান অটোস ‘নিশান সেফিরো’ হিসেবে নিবন্ধনের জন্য বিআরটিএ-তে আবেদন করেছে। কিন্তু বিআরটিএ ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার’ হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে। গাড়িটি আটকের সময় কন্টিন্টোল ওয়ার্কশপ লিমিটেডের কর্মচারীরা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছে স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে। কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘নিশান সেফিরো’ গাড়িকে কিভাবে ‘নিশান জি-টিআর ষ্পোর্টস কার’ হিসেবে নিবন্ধন দিয়েছে-তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন একাধিক কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

Nissan GTR 2
অনুসন্ধান বলছে, জালিয়াত চক্র এই গাড়ি আমদানির একটি ভুয়া ‘বিল অব এন্ট্রি’ তৈরি করেছে। যাতে ভুয়া বিল অব এন্ট্রি নাম্বার, চেসিস নম্বর, ভুয়া সিসি দেখানো হয়েছে। ওই বিল অব এন্ট্রিতে দেখা গেছে, গাড়ির সিসি হলো ২৯৮৮। ২০০৮ সালের ৬ আগস্ট গাড়িটি চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে খালাস নেয়া হয়েছে। ওই বিল অব এন্ট্রিতে ফটোশপের মাধ্যমে কাজ করে কয়েকজন কর্মকর্তার নাম ও পদবি বসানো হয়েছে।

এই বিষয়ে কন্টিন্টোল ওয়ার্কস লিমিটেডের সিনিয়র অপারেশন ম্যানেজার মো. মিজানুর রহমান মিলন বলেন, গাড়িটি ১৫-২০ দিন আগে মারজান অটো থেকে একজন চালক আমাদের কাছে দিয়ে গেছেন। আমাদের বলা হয়েছে গাড়িটির বিভিন্ন জায়গায় ষ্পট পড়েছে, তা রং করে দিতে হবে। পরে কৌশিক আহমেদ ও মনোয়ার নামের দুইজন এসেছেন। কৌশিক আহমেদ মারজান অটোর আত্মীয় বলে জেনেছি। তবে গাড়ির চেসিস নাম্বার পরিবর্তনের বিষয় অস্বীকার করেন এই কর্মকর্তা। অপরদিকে, এই বিষয়ে জানতে মারজান অটোর মনোয়ারের নাম্বারে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!