চেয়ারম্যান-মেয়র পদে সরাসরি ভোট নয়

ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে সরাসরি চেয়ারম্যান ও মেয়র পদে নির্বাচনব্যবস্থা বাতিল করে শুধু সদস্য বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচনের সুপারিশ করেছে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সেইসঙ্গে এটি নির্বাচিত সদস্য ও কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে দ্বিতীয় ধাপে চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত করার সুপারিশ করেছে। অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের চুড়ান্ত প্রতিবেদনে এই সুপারিশসহ মোটাদাগে ৫১টি সুপারিশ করেছে।রোববার (২০এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে কমিশন তাদের দুই খণ্ডের ৫০০ পৃষ্ঠার চুড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর জন্য গত বছরের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদকে প্রধান করে ৮ সদস্যের এ কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিবেদনটি গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা সংস্কার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জনসাধারণের সম্পৃক্ততার প্রতি তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা সম্পূর্ণ প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ করব যাতে নাগরিক, বিশেষজ্ঞ ও অংশীদারেরা প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বুঝতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি ছোটবেলা থেকেই নাগরিক সচেতনতা তৈরির জন্য স্কুলগুলোতে এসব সংস্কার অধ্যয়ন করা উচিত।’

ড. ইউনূস আরও বলেন, আমাদের দেরি করা যাবে না। এসব সংস্কার যত দ্রুত সম্ভব কাগজ থেকে বাস্তবে চর্চা শুরু করতে হবে। প্রতিবেদনটি হস্তান্তরের পর রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন তোফায়েল আহমেদ। এ সময় কমিশনের অন্যান্য সদস্য ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

কমিশনপ্রধান বলেন, মূল সংস্কার না করে কোনো নির্বাচন করে লাভ হবে না। সেটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক আর জাতীয় সংসদ নির্বাচন হোক।এক প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান না জাতীয় সংসদের নির্বাচন আগে হবে সে বিষয়ে সংস্কার কমিশন কোনো স্পষ্ট মতামত দেয়নি। কারণ এটি জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো মিলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে স্থানীয় সরকারের সব জায়গায় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ফলে এখানে দ্রুত নির্বাচন হওয়া উচিত।

কমিশনের সুপারিশগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে স্থানীয় সরকার বলা হলেও সত্যিকার অর্থে কোনো সরকার ব্যবস্থা কার্যকর নয়। উপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার সুবিধার্থে যেভাবে স্থানীয় সরকার কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, এখনও সেভাবে চলে আসছে। এখানে সত্যিকারের স্বাধীনতা নেই। কিন্তু এটা হওয়া উচিত রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, সংস্কার কমিশন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব করেছে। পাঁচ ধরনের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন এক তফসিলে করার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনসাধারণের ভোটে শুধু সদস্য ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত সদস্য ও কাউন্সিলরদের মধ্য থেকে সভাপতি ও চেয়ারম্যান বা মেয়র নির্বাচিত হবেন। এছাড়া চেয়ারম্যান বা মেয়রেরা তাদের সাথে সার্বক্ষণিক কাজ করার জন্য কয়েকজনকে বেছে নেবেন। সার্বক্ষণিক কাজের জন্য নিযুক্ত সদস্য বা কাউন্সিলরদের বেতন আলাদা হবে। আর বাকিরা সার্বক্ষণিক হিসেবে কাজ করবেন না। যারা সার্বক্ষণিক কাজ করবেন না, এ রকম পদে সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীরীরাও নির্বাচন করতে পারবেন।

জাতীয় সংসদের প্রতিরূপ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে সৃষ্টি করার জন্য এই সুপারিশ করা হয়েছে। এজন্য এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা আইনকে এক করে একটি আইন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তিনটি ওয়ার্ড থাকবে, যেখানে শুধু নারীরা নির্বাচন করবেন। বর্তমানের মতো নয়টি ওয়ার্ডকে তিনভাগে ভাগ করে নয়। বর্তমান ব্যবস্থায় নারীরা নির্বাচিত হলেও কোনো কাজ করতে পারেন না। উপজেলা পরিষদের কাঠামো পরিবর্তন এবং জেলা পরিষদে নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওয়ার্ড সংখ্যা বাড়িয়ে ৩৯টি পর্যন্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে সর্বনিম্ন ওয়ার্ড ৯টিই থাকবে।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন মানে অস্থিরতা, অশান্তি, বিশৃংখলা, হতাহত। এজন্য আলাদা আলাদা নির্বাচন না করে একসাথে যাতে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠোনের নির্বাচন করা যায়, সেই সুপারিশ করা হয়েছে। মাত্র ৪০ দিনের একটি শিডিউলে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাচন করা সম্ভব।তিনি বলেন, বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে ২২৫ দিন লাগে। খরচ হয় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। একটি শিডিউলে খরচ নেমে আসবে ৭০০ কোটি টাকায়। আর এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানে ১৯ লাখ জনবল নিয়োগ করতে হয়। একটি শিডিউলে করলে মাত্র ৯ লাখ জনবল নিয়োগ করে করা যাবে। ফলে এই সুপারিশ বাস্তবায়নের বিবেচনার দাবি রাখে। তিনি আরও বলেন, সরকারকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে অর্থায়ন বাড়াতে হবে। বর্তমানে জাতীয় বাজেটের ৫ শতাংশের কম অর্থায়ন হয় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে। সংস্কার কমিশন এটা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে।

কমিশন বলেছে, মোট সংগ্রহ করা মূল্য সংযোজন করের এক-তৃতীয়াংশ স্থানীয় সরকারকে দিতে হবে। স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী এই টাকা স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন হবে। কমিশন জেলা পরিকল্পনা ও জেলা বাজেট ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করেছে বলেও জানান তিনি।

কমিশনপ্রধান বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের সাথে স্থানীয় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর সেবা দিচ্ছে না। ইউনিয়ন পরিষদে আলাদা আলাদা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা না রেখে একটি স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র করতে হবে। সেখানে কমপক্ষে তিনজন চিকিৎসক দিতে হবে, যাদের কমপক্ষে একজন হবেন নারী। পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদ পুরণ করতে হবে। স্কুলগুলোর ম্যানেজিং কমিটিতে মাস্তান প্রবেশ বন্ধ করতে হবে।’

মানুষের বিচার পাওয়া নিশ্চিত করতে উপজেলায় পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি, ফৌজদারি আদালত স্থাপন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে কমিশন। পাশাপাশি গ্রাম আদালতের অপব্যবহার হচ্ছে উল্লেখ করে এ ব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশও করেছে তারা।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ আদালত হলে মানুষ বিচার পাবে। সাক্ষী আনতে পারবে। আবার মামলাও কমবে। বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনও একই সুপারিশ করেছে।তিনি বলেন, বিচার হবে বিচার বিভাগের মাধ্যমে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাহী বিভাগের অংশ। গ্রাম আদালত ইউনিয়ন পরিষদে দিয়ে বিচার করা সংবিধানবিরোধী। তিনি আরও বলেন, স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করতে এর জনবল নিয়োগে লোকাল গভর্নমেন্ট সার্ভিস নামে একটি ব্যবস্থা চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে গ্রাম পুলিশ, টাউন পুলিশ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নিয়োগ হবে।

স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ এসেছে এই সংস্কার কমিশনের সুপারিশে। পার্বত্য এলাকায় হেডম্যান, কারবারি ব্যবস্থার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চালু এবং বাজার ফান্ড বিলুপ্ত করা এবং উন্নয়ন কাজে কর ও ভ্যাট মওকুফ করার নিয়ম বাতিল করার সুপারিশ করেছে কমিশন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকর করতে এর নাম পরিবর্তন, দুটো বিভাগের মধ্যে আরও সমন্বয় করা, প্রকৌশল বিভাগকে একসাথে কাজ করানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া ভূমির অপব্যবহার রোধে ভূমি ব্যবহার আইন, জাতীয় ভৌত অবকাঠামো পরিকল্পনা করার সুপারিশ করা হয়েছে।

কমিশন বলেছে, ভূমি ব্যবহারে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। যেখানে সেখানে ভৌত অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। এর ব্যপ্তি আটকানো না গেলে ভবিষ্যতে অসুবিধা হবে বিবেচনা করে এ সুপারিশ করা হয়েছে।কমিশন ছয়টি আইন করার সুপারিশ করেছে। এসব আইনের খসড়াও তৈরি করে দিয়েছে কমিশন। পাশাপাশি আরও কয়েকটি আইন সংশোধন করার সুপারিশ করেছে। স্থানীয় সরকারের সাথে সম্পৃক্ত প্রশাসনেরও সংস্কারের সুপারিশ করেছে কমিশন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!