জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে রাজি নন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা। তাদের মতে, একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিকে অপসারণের দাবি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ আজ একজনকে সরানোর দাবি উঠলে, কাল তা অন্যদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে—এতে সমস্যা আরও ঘনীভূত হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিরসনে তাঁরা বলছেন, আলোচনা মঙ্গলবার (১ জুলাই) নয়, আজই শুরু হওয়া উচিত। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তাঁরা। শনিবার (২৮ জুন) রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে দেশের শীর্ষ ১৩টি ব্যবসায়ী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক শীর্ষ নেতারা।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ)। এসময় উপস্থিত ছিলেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স ইন বাংলাদেশ (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান, বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি কামরান টি রহমান, সিরামিক শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিসিএমইএ সভাপতি মঈনুল ইসলাম, বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, মেট্রো চেম্বারের সহ-সভাপতি ও ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান, ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, এনবিআরের চেয়ারম্যানের অপসারণ কোনোভাবেই কাম্য নয় এবং এতে সফলতা আসবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন না। দেশ ও ব্যবসার স্বার্থে আলোচনা সভার মাধ্যমে সমস্যাগুলো সমাধানের ওপর জোর দেন তাঁরা। কমপ্লিট শাটডাউনের ফলে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, চলমান স্থানীয় ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে ব্যবসায়ীরা এনবিআরের অচলাবস্থার কারণে আরও কষ্ট পাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে আসার আহ্বান জানানো হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা জানান, সব কর্মকর্তা অসৎ নয়, তাদের ভবিষ্যতও বিবেচনায় নিতে হবে সরকারকে।
এই আন্দোলনের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা তৈরি হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালের সঙ্গে ঠেকে গেছে। তাই দেরি না করে আজই প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) যৌথ উদ্যোগে আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা জরুরি। তাঁদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং দেশের অর্থনীতি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এ সময় তাঁরা আন্দোলনকারীদের দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কলম বিরতি ঘোষণা করে কমপ্লিট শাটডাউন প্রত্যাহার করে কোনও শর্ত ছাড়াই কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইসিসিবির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের মিথস্ক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে এই সংলাপ বেশ স্থিমিত রয়েছে। চেয়ারম্যানের অপসারণের পর হয়তো সংস্থার অন্য কোনো সদস্যের অপসারণের দাবিও উঠতে পারে, যা সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
শাটডাউনের কারণে রপ্তানিতে ক্ষতির বিষয়ে এলএফএমইএবি সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার আমাদের এবং বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করবে না। যুদ্ধ বিরতি ছাড়া কোনো দেশের কাস্টমস বন্ধ থাকে না, যা আমাদের জানা নেই। ব্যবসায়ীরা এনবিআরের সংস্কার চায়, তবে সেখানে অনেক সৎ কর্মকর্তা আছেন। বর্তমান সংস্কারের ফলে তাঁদের ভবিষ্যত কী হবে, সেটি বলার অধিকারও তাঁদের রয়েছে এবং এই বিষয়টিও সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে।
এনবিআরের চলমান সমস্যার প্রসঙ্গে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘এনবিআরে চলমান যেই সমস্যা হচ্ছে, সেটা ক্ষমতা ও টাকা পয়সা বণ্টন নিয়ে ঝগড়া। মাঝখানে আমরা (ব্যবসায়ী) হচ্ছি বিপদগ্রস্ত। এনবিআরের কর্মকর্তারা এতদিন আমাদের (ব্যবসায়ী) জ্বালিয়েছে। এখন সরকারকে জ্বালাচ্ছে। এরপর পুরো জাতিকে জ্বালাবে। দেশের স্বার্থে এসব সমস্যার সমাধান জরুরি বলে জানান তিনি।
লিখিত বক্তব্যে সংগঠনগুলো বলছে, ‘কলম বিরতিতে দেশের আমদানি-রপ্তানি মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা সময়মত আমদানির কাঁচামাল খালাস করতে পারছেন না। ফলে দেশের রপ্তানিতে বর্ধিত লিড টাইম আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া সমুদ্র বন্দর ও বিমানবন্দরে পণ্য পড়ে থাকায় নষ্ট হচ্ছে। আংশিক কর্মঘণ্টার কারণে এক কর্ম দিবসের মধ্যে প্রত্যাশিত ইউপি পেতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লেগে যাচ্ছে।’
চলমান সমস্যার সমাধান চেয়ে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাবসায়িক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে সাতটি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আন্দোলনকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনা করে বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা; উত্তম কর তথা রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও প্রণীত নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আলাদাকরণ সংক্রান্ত বিতর্কিত অধ্যাদেশ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা; এরপর তা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাবমুক্ত রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও দেশের বাস্তবতার আলোকে বাস্তবায়ন; জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ ব্যবসা বাণিজ্যের সার্বিক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সব জাতীয় প্রতিষ্ঠানে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদানের লক্ষ্যে এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য রেগুলেটরি ও ফ্যাসিলিটেটিং প্রতিষ্ঠানগুলোর সামগ্রিক ও সমন্বিত উন্নয়নের লক্ষ্যে অংশীজনদের সাথে আলোচনা করে আধুনিকায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা; অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে নিদের্শ দেওয়া।সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত কর্মচারীদের কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়।
** শাটডাউন ও মার্চ টু এনবিআর চলমান থাকবে
** কমপ্লিট শাটডাউন চলছে, অবরুদ্ধ এনবিআর
** জনগণ সেবা পাচ্ছেন না, নিজ অফিসে না থাকলে শাস্তি
** শাটডাউন প্রত্যাহার হয়নি, চলবে: ঐক্য পরিষদ