এক সময় দেশজুড়ে চিংড়ির বাণিজ্য ছিল তুঙ্গে, ‘সাদা সোনা’ নামে পরিচিত এই শিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠে বহু প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। তবে চিংড়ির সংকটের কারণে বর্তমানে এই শিল্প মারাত্মক মন্দার কবলে পড়েছে। গত সাত বছরে রপ্তানি অর্ধেকে নেমে আসায় অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, হুমকির মুখে টিকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ।
একসময় চিংড়ি দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। গ্রামীণ কর্মসংস্থানে অবদান রেখেছিল বেশ। এখন কাঁচামালের ঘাটতি, বিশ্বব্যাপী চাহিদা কম, জলবায়ু পরিবর্তন, আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও পরিবর্তিত বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে এই শিল্প হিমশিম খাচ্ছে।কম সুদে ব্যাংক ঋণ, রপ্তানি ভর্তুকি ও ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চাহিদার কারণে ১৯৯০ এর দশকে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে উপকূলীয় অঞ্চলে অনেক চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা গড়ে উঠে।
প্রায় এক দশক এই শিল্পে রমরমা ভাব দেখা গিয়েছিল। তবে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি সরকারি প্রণোদনা হ্রাস পায়।ফলে উৎপাদনও কমতে শুরু করে। দেশীয় বাজারে চিংড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আরও কমতে শুরু করে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্য বলছে—বর্তমানে ১০৯টি নিবন্ধিত চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মধ্যে খুলনায় ৩০ ও চট্টগ্রামে ১৮টি চালু আছে।চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণের প্রাথমিক কাঁচামাল হলো লবণ পানিতে চাষ করা চিংড়ি (বাগদা) ও মিঠা পানির চিংড়ি (গলদা)।প্রতিষ্ঠানটির সূত্রে জানা গেছে, এসব কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় চার লাখ টন হলেও তারা প্রয়োজনীয় চিংড়ির মাত্র সাত শতাংশ পাচ্ছেন।
ফ্রোজেন ফুড অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক ও এমইউ সি ফুড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, কাঁচামালের অভাবে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজের প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় চিংড়ির ২৫-৩০ শতাংশ পাচ্ছে। ফলে সারাবছর কারখানা চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। চিংড়ির সংকটে বন্ধ হচ্ছে কারখানা, ভেনামি চাষ সম্প্রসারণে সরকারের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চিংড়ির সংকট এতটাই তীব্র যে, দেশের চালু কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় চাহিদার মাত্র ১০ থেকে ১৫ শতাংশ চিংড়ি পাচ্ছে। ফলে শুধুমাত্র কাঁচামালের অভাবেই অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার নিজের প্রতিষ্ঠানেও প্রয়োজনীয় চিংড়ির মাত্র ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সরবরাহ পাচ্ছি, যা দিয়ে সারা বছর কারখানা চালানো সম্ভব নয়।’তিনি মনে করেন, এই সংকট মোকাবিলায় সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ভেনামি চিংড়ি চাষ বাড়াতে হবে।
শ্যামল দাস বলেন ,আমি বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি, যিনি পরীক্ষামূলক ও বাণিজ্যিকভাবে ভেনামি চাষ শুরু করি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, যেখানে প্রচলিত পদ্ধতিতে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন প্রতি হেক্টরে ৪০০ থেকে ৫০০ কেজি, সেখানে ভেনামি চাষে উৎপাদন ৯,০০০ থেকে ১০,০০০ কেজিতে পৌঁছায়।’তাই চিংড়ি শিল্পকে বাঁচাতে হলে ভেনামি চিংড়ি চাষকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রসারিত করতে হবে’ বলে মনে করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহ ঘাটতির ফলে উৎপাদন কমেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চিংড়ি শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবন সংকটে।
গবেষক গৌরাঙ্গ নন্দী তার ‘শ্রিম্প প্রফিট ফর হোম’ বইয়ে লিখেছেন, ‘১৯৯৫ থেকে ২০০৩-০৪ সালে এই সময়ের মধ্যে (চতুর্থ ফিশারিজ প্রজেক্ট এর সময়ে) চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকরা এই খাতে বিনিয়োগ শুরু করেন। কিন্তু তারা বাজারে চিংড়ির প্রাপ্যতা বা সেই ধরনের ম্যাপিং করেছেন বলে আমি মনে করি না।’ বরং উদ্যোক্তাদের অসততা ও ব্যাংকিং সেক্টরের দূরদর্শিতার অভাবে এটি ফুলে-ফেঁপে ওঠে এবং হঠাৎ ধসে পড়ে। প্রক্রিয়াকরণ কারখানা দেখিয়ে অনেকে ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়েছেন এবং পরবর্তীতে খেলাপি হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘২০০৮ সালে আন্তর্জাতিকভাবে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশেও ব্যাপকহারে খাদ্য সংকট শুরু হয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা তখন নিজেদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেন। তাদের ভেতরে এমন ধারণার জন্ম হয় যে, শুধু টাকা থাকলেই চাল কেনা যাবে না।’
গৌরাঙ্গ নন্দী জানান, তখন ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে চিংড়ি চাষ বন্ধ করে ধান চাষে মনোযোগ দেন। অনেক জায়গায় চিংড়ি চাষ বন্ধ হওয়ার আন্দোলন শুরু হয়। ২০০৯ সালে আইলা ঘূর্ণিঝড়ে অনেক চিংড়ির ঘের নষ্ট হয়। উৎপাদনে ব্যাপক ভাটা পড়ে। মূলত ওই সময় থেকে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়া শুরু হয়।
চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত ব্যবসায় ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার বড় বাধা
চিংড়ি প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ হার তাদের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এই খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাণিজ্যিক হারে ঋণ নিতে হচ্ছে। এখানে সুদের হার ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ। তারা মনে করেন, চিংড়ি চাষের মতোই প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিকে কৃষি কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করা উচিত, যাতে কৃষি ঋণের আওতায় সাত শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যায়।
তাদের অভিযোগ, চিংড়ি চাষকে কৃষি কার্যক্রমের আওতায় রাখা হলেও, প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানিকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম হিসেবে ধরা হচ্ছে। ফলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এটি তাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।
কমছে উৎপাদন
দেশে চিংড়ির উৎপাদন কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে আছে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, পানির লবণাক্ততা, চিংড়ির ঘেরের গভীরতা কমে যাওয়া, নিম্নমানের চিংড়ির পোনা, অপর্যাপ্ত পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং মাটি-পানির উর্বরতা কমে যাওয়া।এই প্রতিটি বিষয় পরিবেশগত বিপর্যয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ঘূর্ণিঝড় আইলা, আম্ফান ও ইয়াসের কারণে অনেক চিংড়ি ঘের ধ্বংস হয়ে গেছে। ফলে প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হওয়ায় অনেকে চিংড়ি চাষ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।জলবায়ু পরিবর্তন, চিংড়ি পোনার প্রাপ্যতা কমে যাওয়া ও আর্থিক অব্যবস্থাপনা এ শিল্পকে সংকটে ফেলেছে। পুরোনো চাষ পদ্ধতি এই শিল্পের বিকাশকেও বাধাগ্রস্ত করেছে।
দেশে ৫০ থেকে ৬০ বছর ধরে চিংড়ি চাষ হওয়া সত্ত্বেও চাষ কৌশলে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি খুবই কম। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও কক্সবাজারের চাষিরা চিংড়ি ঘেরে পানির সংকট ও রোগবালাই বেড়ে যাওয়ায় লোকসান গুনছেন।এ ছাড়াও, চিংড়ি চাষিরা ব্যাংক ঋণ পেতে অসুবিধায় পড়ছেন। অনেকে ব্যক্তিগত সঞ্চয় বা উচ্চ সুদে ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ায় তাদের আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে।ফলে অনেকে চিংড়ি চাষ একেবারেই ছেড়ে দিয়েছেন। আবার কয়েকটি এলাকায় চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের আন্দোলন দেখা দিয়েছে।
ভেনামি চিংড়ি কি সমাধান?
বিশ্ববাজারে বাগদা ও গলদার দাম ভেনামি বা বা ওই জাতীয় প্রজাতির চিংড়ির তুলনায় বেশি। কম খরচ, উচ্চ ফলন ও আধুনিক চাষ কৌশলের সঙ্গে সামঞ্জস্যের মাধ্যমে ভারত, চীন ও ভিয়েতনাম রপ্তানির জন্য বড় আকারে ভেনামি চাষ করছে।তবে বাংলাদেশ এখনো ভেনামি চিংড়ির বাণিজ্যিক চাষের অনুমোদন দেয়নি। চিংড়ির খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চাষি, ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন যাবৎ বছরের পর বছর ধরে অনুমতির জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু হয়েছে অনেক জায়গায়। তবে পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকার এটিকে ধীরে ধীরে অনুমোদনের দিকে এগোচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
বিএফএফইএ সূত্রে জানা গেছে—জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের কারণে মৎস্য অধিদপ্তর ভিনদেশি চিংড়ি চাষের অনুমতি দিতে রাজি না।ভেনামি চাষের পক্ষে যুক্তি দিয়ে কৃষক সুতনু কবিরাজ বলেন, ‘প্রচলিত বাগদা চিংড়ি চাষে প্রতি হেক্টরে ৪০০-৫০০ কেজি ও ভেনামি চিংড়ি প্রতি হেক্টরে ৯,০০০-১০,০০০ কেজি পাওয়া যায়।’
চিংড়ি বিনিয়োগকারীদের উত্থান-পতন
বিএফএফইএর সাবেক সহ-সভাপতি এস হুমায়ুন কবির বলেন, ‘গত ১০ বছরে শুধু খুলনা অঞ্চলের প্রায় ২৫টির মতো চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এগুলো আসলে বন্ধ হওয়া শুরু হয়েছে ২০০০ সালের পর থেকে। তখন অনেকগুলো চিংড়ি কারখানা হঠাৎ করে এই ব্যবসায় আসে তারপর হঠাৎ করেই ব্যবসা ছেড়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের কারখানাগুলো পর্যাপ্ত চিংড়ির অভাবে ঠিকমতো পরিচালিত হতে পারছে না। অথচ স্থানীয় বাজারে চিংড়ির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। ক্রেতারা এখন বেশি দামে চিংড়ি কিনতে পারছেন। ফলে বেশিরভাগ উৎপাদক রপ্তানির পরিবর্তে স্থানীয় বাজারেই চিংড়ি বিক্রিতে আগ্রহী।’
তবে চাষিদের অভিযোগ, ঘের থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করে কারখানায় নিয়ে আসার পর নানা রকমের সমস্যা পড়তে হয়। বিভিন্ন গ্রেডের অজুহাতে অনেক সময় তাদেরকে প্রকৃত দাম থেকে বঞ্চিত করা হয়। কখনো কখনো সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দাম কম পান বলে কৃষকরা খোলা বাজারে চিংড়ি বিক্রি করছেন। প্রত্যন্ত এলাকাতেও এখন চিংড়ির অনেক ক্রেতা আছেন। তাই তারা খোলা বাজারে চিংড়ি বিক্রি করেন। সিন্ডিকেটের মধ্যে আসতে চান না।
ইতোমধ্যে খুলনা অঞ্চলের ছবি সি ফুড লিমিটেড, স্টার সি ফুড লিমিটেড, জাহানারা, মডার্ন, এলএফপিসিএফ, সাউথ ফিল্ড, কসমস, শম্পা, ওরিয়েন্টাল, বাংলাদেশ সি ফুড, এশিয়া সি ফুড, মালেক হাজী সি ফুড, ইউনিক আইস অ্যান্ড ফুড লিমিটেড, অ্যাপোলো সি ফুড লিমিটেড, শাহনেওয়াজ সি ফুড ও বেক্সিমকোসহ বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সদস্য অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির জানান, পরিবেশগত সমস্যার পাশাপাশি চিংড়ি রপ্তানিকারকদের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি সংকটকে আরও গভীর করেছে। তিনি বলেন, কিছু কারখানার মালিক চিংড়ি উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ ব্যাংক ঋণের অপব্যবহার করে তা অন্যান্য ব্যবসায় খাটিয়েছেন এবং ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। তার মতে, দুই-তৃতীয়াংশ কারখানার মালিক ঋণের টাকা অন্য খাতে সরিয়ে নেওয়ার পর এখন তা পরিশোধে অনাগ্রহী, যা কারখানা বন্ধ হওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।