বন্ধ থাকা সাত বিমানবন্দর চালু হচ্ছে

সড়ক ও রেলপথের চাপ কমানো ও পর্যটনসহ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো সচল করার। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ২৮টি বিমানবন্দরের মধ্যে সাতটির কার্যক্রম দ্রুত চালু করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এসব বিমানবন্দর সংস্কার ও ব্যয় নিরূপণের প্রতিবেদন ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো হয়েছে।এই সাতটির মধ্যে বগুড়া বিমানবন্দরে চলতি বছরের জুলাই থেকেই বিমান চলাচল শুরুর প্রস্তুতি চলছে। প্রায় দুই দশক ধরে ফাইলবন্দি থাকা এই প্রকল্প এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঈশ্বরদী, সম্ভাবনাময় ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট, পর্যটনকেন্দ্র শমসেরনগর (মৌলভীবাজার), ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা এবং রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো পর্যায়ক্রমে সচল করা হবে। তবে অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতি যেখানে আগে শেষ হবে, সেগুলো আগে সচল হবে। সবার আগে চালু হবে বগুড়া বিমানবন্দর। আসছে জুনে সব প্রস্তুতি শেষ হলেই সেখানে বিমান চলবে। যদিও বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনার জন্য কিছুটা সময় লাগবে। বেবিচকের চেয়ারম্যান আশা করছেন, এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে বিমানবন্দরগুলো সচল হলে বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনা করা যাবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৯৬ সালে নির্মাণ শুরু হয়ে ২০০০ সালে শেষ হওয়া বগুড়া বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম আগামী দুই মাসের মধ্যেই শেষ হবে। এরপরই সেখানে বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনা করা যাবে। পাশাপাশি আগামী বছরেই অন্তত তিনটি বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু করবে বেবিচক। পরিত্যক্ত এসব বিমানবন্দর চালুর পাশাপাশি ফ্লাইট বাড়ানোরও পরিকল্পনা রয়েছে। এসব ব্যাপারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়াও অন্য বিমান পরিচালনা সংস্থা ইউএস বাংলা, নভোএয়ার ও এয়ার এস্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।

সিভিল এভিয়েশনের সূত্রমতে, দেশের বিভিন্ন জেলায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ২৮টি বিমানবন্দরের মধ্যে বর্তমানে রাজধানীর সঙ্গে আটটির বিমান চলাচল অব্যাহত রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দর। বাণিজ্যিকভাবে সচল বাকি চারটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর রয়েছে রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশালে। এসব সচল রুটের সঙ্গে চলতি বছর থেকে শুরু করে আগামী এক-দেড় বছরের মধ্যেই যুক্ত হবে বগুড়া, ঈশ্বরদী, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, কুমিল্লা, মৌলভীবাজারের শমসেরনগর ও রাজধানীর তেজগাঁও বিমানবন্দর।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য পরিত্যক্ত সাতটি বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও বিমান ওঠানামার জন্য দরকারি অবকাঠামো নেই। যাত্রীবাহী বিমান পরিচালনায় অনুপযুক্ত এসব রানওয়ে সচল ও কার্যকর করতে জরুরিভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কার প্রয়োজন। ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার ফুটের মধ্যে থাকা এসব রানওয়ে উন্নীত করে ৬ থেকে ৮ হাজার ফুটের মধ্যে আনতে হবে। তবেই বাণিজ্যিকভাবে বিমান পরিচালনা করা যাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেবিচকের এক প্রকৌশলী জানান, পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলোর বেশ কয়েকটির রানওয়ে বেদখল হয়ে গেছে। কোনোটাতে গবাদি পশুর অবাধ বিচরণ, কোনোটিতে বাউন্ডারি ওয়াল ভেঙে পড়েছে। কোথাও আবার নেই নিরাপত্তা চৌকি। ফলে এসব বন্দরের রানওয়ে দখলমুক্তসহ সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করতে হবে। এসব কার্যক্রম অনেক জটিল হওয়ায় কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলোর কোনো কোনোটিতে জমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে রানওয়ে ও ট্যাক্সিওয়ের শক্তি বাড়ানো হবে। ঐ প্রকৌশলী আরও জানান, সবার আগে বগুড়া বিমানবন্দরের কার্যক্রম শুরু হবে। টেন্ডারের মাধ্যমে বিদেশ থেকে লাইটিংসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম আনা হচ্ছে। জুনের মধ্যে সব কার্যক্রম শেষ হলে জুলাই থেকে রানওয়েতে বিমান উড়তে পারবে।

বিমান সূত্রমতে, বিগত সময়ে বগুড়া, ঈশ্বরদীসহ কয়েকটি বিমানবন্দরের কার্যক্রম কিছুদিনের জন্য চালু হলেও হঠাৎ তা বন্ধ হয়ে গেলে নানা মহলে বিতর্ক ও সমালোচনা হয়। এর মধ্যে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরিত্যক্ত বিমানবন্দরগুলো সচল করার দাবি জোরালো হয়ে উঠলে নতুন করে উদ্যোগ নেয় সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় বিএনপি সরকারের আমলে নির্মিত বগুড়া বিমানবন্দর চালু করতে বেবিচকের প্রধান কার্যালয়ে বিশেষ বৈঠক হয়। এতে বিমানবন্দরটি সচল করতে বিভিন্ন খাতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বাজেট নিরূপণ করা হয়। ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। আগামী দুই মাসের মধ্যেই বিমান চলাচলের জন্য উপযুক্ত হবে বগুড়া বিমানবন্দর।

এদিকে, পাবনার রূপপুরে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরুর পর থেকেই ঈশ্বরদী বিমানবন্দর চালুর জোর দাবি উঠেছে। যদিও ১৯৬২ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রূপপুরের সঙ্গে ঢাকার বিমান যোগাযোগ স্বাভাবিক ছিল। যেখানে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়াও স্থাপিত হয়েছে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড)। অভিযোগ রয়েছে, ঈশ্বরদী বিমানবন্দরে রানওয়ের দৈর্ঘ্য যেমন কম তেমনি পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ও ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনার অভাব। ফলে রানওয়ে সম্প্রসারণসহ অন্যান্য কার্যক্রম শুরুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের নগরীখ্যাত কুমিল্লা বিমানবন্দর ১৯৭৬ সাল অবধি বাণিজ্যিকভাবে সচল থাকলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে এসে ফের চালু হলেও পর্যাপ্ত যাত্রী না থাকায় পরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। তবে ইপিজেড স্থাপনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে দ্রুত শিল্পায়ন ও ব্যবসার প্রসার ঘটেছে। ফলে দ্রুততম সময়ে রাজধানীসহ সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধায় বিমানপথের দাবি উঠেছে। একইভাবে রাজধানীর তেজগাঁও সচল করারও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকা মৌলভীবাজারের শমশেরনগর ও সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট বিমানবন্দরের অবকাঠামো বর্তমানে বাণিজ্যিক বিমান চলাচলের উপযোগী না হলেও, এসব অঞ্চল এখন পর্যটন ও অর্থনীতির সম্ভাবনাময় কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। ফলে, দ্রুত ও কার্যকর যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা থেকে এসব বিমানবন্দর সচলের দাবি অনেক আগেই ওঠে।এই প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দরগুলো সচল করতে ইতোমধ্যে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দ্রুত শিল্পায়ন, ব্যবসার সম্প্রসারণ এবং পর্যটন খাতের বিকাশে একসময় সচল থাকা কিন্তু এখন পরিত্যক্ত এসব বিমানবন্দর পুনরায় চালু হলে বদলে যেতে পারে স্থানীয় অর্থনীতির গতি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!