চার বছরে ১৩.৪০ শতাংশ শিশু ধর্ষণ বেড়েছে

দেশে কন্যাশিশু যৌন নিপীড়নের হার বাড়ছে। গত মার্চ মাসে ধর্ষণের শিকার ১৬৩ জনের মধ্যে ১২৫ জন কন্যাশিশু। অর্থাৎ এ সময় কন্যাশিশু ধর্ষণের হার ৭৬.৬৯ শতাংশ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা যায়।নারী ও শিশু মানবাধিকার সংস্থার ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বার্ষিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার মোট ভুক্তভোগীর দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৬ শতাংশ কন্যাশিশু, যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এই হার প্রতিবছর উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বিগত চার বছরে শিশু ধর্ষণের হার ১৩.৪০ শতাংশ বেড়েছে।

অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, শিশুরা অবুঝ ও প্রতিবাদ করতে পারে না বলে তারাই বেশি যৌন নিপীড়নের ঝুঁকিতে।অপরাধীরা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের হীন উদ্দেশ্য হাসিল করে ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা চালায়। অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণেও এ ধরনের অপরাধ ঘটে। অনেক সময় মা-বাবা শিশুদের গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে রেখে বাইরে যান, যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যাসহ ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করা ভুক্তভোগীদের ৭১.১২ শতাংশ কন্যাশিশু, যা ২০২৩ সালে ছিল ৬৭.৪৫ শতাংশ, ২০২২ সালে ৬৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ছিল ৫৭.৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ শিশু ধর্ষণের হার ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। চার বছরে এই হার বেড়েছে ১৩.৪০ শতাংশ।

নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, দেশের ১৪টি জাতীয় পত্রিকা থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনগুলো প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে ধর্ষণের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া যায় না। তবে বর্তমান সমাজে নারী ও শিশুদের প্রতি যে নির্যাতন করা হচ্ছে, এর একটি প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়।

তিনি বলেন, ‘ধর্ষণ শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রথমে এই অপরাধকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এটি শুধু একজন নারী বা শিশুর জীবন নয়, বরং একটি সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। ফলে শুধু নারী সমাজ নয়, এর বিরুদ্ধে পুরো সমাজকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের যে শিশু অধিকার সনদ আছে, এ বিষয়ে সমাজের কোনো ধারণা নেই। অভিভাবকরাও এ বিষয়ে জানেন না, রাষ্ট্র্রও এটা জানানোর চেষ্টা করে না। এতে প্রতিকারও পাওয়া যাচ্ছে না। ধর্ষণ রোধে শুধু আইন করলেই হবে না, দ্রুততম সময়ে বিচার করতে হবে। বিচারে প্রাপ্ত সাজা সমাজে ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে একদিকে বিচারের ফল ভুক্তভোগীর জীবনকে পাল্টে দিতে পারে, একই সঙ্গে সমাজে এ ধরনের অপরাধের হার অনেকাংশে কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে প্রতি আটজন নারী ও শিশুর মধ্যে অন্তত একজন ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।

বাংলাদেশে এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিশু ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধীরা বেশির ভাগ ভুক্তভোগীদের পরিচিত। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যম ও স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো শিশু ধর্ষণের প্রায় ৫০টি ঘটনা রেকর্ড করেছে। আর এই প্রবণতা যেন দিন দিন আরো ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। শুধু ১০ মার্চ, এই এক দিনে সাতজন শিশু ধর্ষণ-হত্যার শিকার এবং ছয়জন শিশুর ক্ষেত্রে সহিংসতার ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

গত ২৩ মার্চ ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশে গত কয়েক সপ্তাহে শিশুদের ওপর, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার খবর উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় আমি গভীরভাবে আতঙ্কিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো যেসব জায়গায় শিশুদের সুরক্ষিত পরিবেশে বেড়ে ওঠার কথা, সেসব জায়গাসহ অন্যত্র শিশু ধর্ষণ ও শিশুদের ওপর যৌন সহিংসতার ভয়ানক ঘটনাগুলো সম্প্রতি যেভাবে বেড়েছে, তা নিয়ে আমি বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন।’

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা

গত বুধবার নেত্রকোনার আটপাড়ায় ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানায়, শিশুটিকে বাসায় একা রেখে বাবা কাজে গেলে প্রতিবেশী যুবক ভয় দেখিয়ে তার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়।গত ৮ এপ্রিল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ১২ বছরের আরেক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিবারের অভিযোগ, মা-বাবা কাজে গেলে পাশের বাড়ির ভাড়াটিয়া শিশুটিকে যৌন নির্যাতন করে।

গত ৭ এপ্রিল ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলায় সাড়ে চার বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ জানায়, টাকা ও মুঠোফোনের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিবেশী যুবক শিশুটিকে ডেকে নিয়ে এই নির্যাতন চালায়।সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত ঘটনার মধ্যে রয়েছে মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণ। গত ৬ মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয় শিশুটি। নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে বোনের স্বামী, শ্বশুর ও তাঁর দেবরের বিরুদ্ধে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেকে পরিবার বা বাইরে থেকে নির্যাতিত হলেও অভিযোগ করতে চান না। শিশুরা আরো বেশি নীরব থাকে। এ কারণে শিশুরাই বেশি ভুক্তভোগী হয়।ধর্ষণ রোধে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে গিয়ে খুব বেশি সহযোগিতা পায় না। অনেক ঘটনায় পুলিশ মামলা নিতে আগ্রহ দেখায় না। সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেয়। অভিযোগ করার পর দোষীদের সঙ্গে দেনদরবারের মাধ্যমে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলে। হয়তো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাব বা সামাজিক শক্তি সেখানে কাজ করে। আবার মামলা নেওয়ার পর আদালতেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায়। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে দ্রুততম সময়ে বিচারকাজ শেষ করার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!