চার দাবিতে অনড়, প্রধান উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি

এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ

** ২৪ মে শনিবার ও ২৫ মে রোববার সকল কাস্টম হাউস ও এলসি স্টেশন ব্যতীত কাস্টমস, ভ্যাট ও কর বিভাগের সকল অফিসে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করা হবে। এই দুইদিন কাস্টম হাউস ও এলসি স্টেশনে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে
** ২৬ মে সোমবার আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতীত সকল আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টম হাউসে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালিত হবে

এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশ বাতিল, চেয়ারম্যানের অপসারণসহ চার দাবিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’। পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (২২ মে) বিকেলে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে গিয়েছেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা, অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, উপকর কমিশনার শিহাবুল ইসলাম কুশল, রাজস্ব কর্মকর্তা মো. শফিউল বসর ও কর পরিদর্শক মুতাসিম বিল্লাহ। স্মারকলিপি দেওয়ার আগে বৃহস্পতিবার এনবিআর ও এনবিআরের অধীনস্থ সকল ভ্যাট, কাস্টমস ও আয়কর অফিসে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়।

স্মারকলিপি দেওয়ার আগে এনবিআরের নিচে অতিরিক্ত কর কমিশনার সেহেলা সিদ্দিকা বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের যে আর্জি আছে, সেগুলো লিখিতভাবে পৌঁছানোর জন্য আমরা যাচ্ছি। আমরা সব সময় এনবিআর সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাতিল চেয়ে আসছি। অধ্যাদেশ বাতিলসহ আমরা চারটি দাবি করছি, যা উপদেষ্টার কাছে পৌঁছানো হবে।’
NBR Cefaration Photo

দাবি চারটি হলো-জারি করা অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করা; অবিলম্বে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা; রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা; এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়া এবং পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কার নিশ্চিত করা।

NBR Ce 01
এর আগে এই চার দফা দাবিতে বুধবার (২১ মে) এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-বুধবার থেকে সংবাদ সম্মেলনের পর থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে লাগাতার অসহযোগিতা বা অসহযোগ কর্মসূচি পালন করা; ২২ মে বৃহস্পতিবার দুপুরে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবিসমূহের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করা; একইদিন বৃহস্পতিবার এনবিআর এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে স্ব-স্ব দপ্তরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে। তবে, রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এর আওতামুক্ত থাকবে। ২৪ মে শনিবার এবং ২৫ মে রোববার সকল কাস্টম হাউস এবং এলসি স্টেশনসমূহ ব্যতীত ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি চলবে। এই দুইদিন কাস্টমস হাউস এবং এলসি স্টেশনসমূহে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কর্মবিরতি চলবে। তবে, রপ্তানি ও আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে। আগামী ২৬ মে সোমবার থেকে আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা ব্যতীত ট্যাক্স, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সকল দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করা হবে।

অপরদিকে, স্মারকলিপিতে বলা হয়, চলমান সংস্কার কর্মসূচীর অংশ হিসেবে রাজস্ব নীতি ও বাস্তবায়ন পৃথকীকরণের লক্ষ্যে সরকার শতবর্ষ প্রাচীন ও পরীক্ষিত এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি বিভাগ এবং রাজস্ব বাস্তবায়ন বিভাগ নামে দুটি বিভাগ গঠনের লক্ষ্যে গত ১২ মে দিবাগত মধ্যরাতে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়। দেশের উন্নয়নের অক্সিজেন রাজস্ব আহরণের প্রাণভোমরা এনবিআর বিলুপ্তির অধ্যাদেশটি অত্যন্ত গোপনে, অতি দ্রুততার সঙ্গে এবং প্রত্যাশী সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনকে অজ্ঞাত রেখে জারি করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশে জাতীয় স্বার্থকে ক্ষুন্ন করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা প্রভাবশালী মহলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাংগঠনিক স্বাতন্ত্র্য ও পেশাগত স্বকীয়তাকে অস্বীকার করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল কাঠামো বিনষ্ট করে রাজস্ব আহরণের প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কার্যক্রমটি বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর সাথেও সাংঘর্ষিক। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সার্বিক কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এনবিআর বিলুপ্তির স্বপক্ষে যথাযথ তথ্য-উপাত্তবিহীন প্রচলিত ধারণা ও প্রকৃত বাস্তবতা

স্বাধীনতার পর থেকে রাজস্ব আহরণে এনবিআরের ধারাবাহিক ব্যর্থতার অভিযোগের বিপরীতে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর হতে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৬.৪৪ শতাংশ, যা যেকোনো রাজস্ব কর্তৃপক্ষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। এই অর্জন প্রমাণ করে যে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এনবিআর তার দায়িত্ব পালনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থেকেছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আহরণ ছিল মাত্র ১৬৬ কোটি টাকা। ১৯৯১ সালে চালুকৃত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) এর ধারাবাহিকতায় ২০০০-০১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮,৭৪৪.৪৪ কোটি টাকা, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৩,৮২,৬৭৮ কোটি টাকায়। বর্তমানে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ রাজস্বের প্রায় ৮৬ শতাংশই এনবিআরের মাধ্যমে আহরিত হয়, যা জাতীয় উন্নয়ন ব্যয়ের বড় অংশে সরাসরি অবদান রাখে।

বাংলাদেশের বর্তমান কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৭.৪ শতাংশ, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় অন্যতম সর্বনিম্ন। এই হার যে অত্যন্ত হতাশাজনক, তা অনস্বীকার্য। কর-জিডিপি অনুপাত কমের জন্য এনবিআরকে এককভাবে দায়ী করা হয়। অথচ বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সহ দেশের অন্যান্য থিংক ট্যাংক ও প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদিদের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে এর পেছনে রয়েছে একাধিক গভীর কাঠামোগত ও নীতিগত কারণ, যেমন: বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের অতিরঞ্জিত ও অতিমূল্যায়িত জিডিপি, জিডিপির ভিত্তি বছর পুনর্মূল্যায়নের প্রভাব, কর অব্যাহতির উচ্চ হার, বিশাল অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির পরিসর, এন্টারপ্রাইজওয়াইড ইন্টিগ্রেটেড সিস্টেমের অভাব এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অতিরঞ্জিত জিডিপির পরিসংখ্যান সংশোধন করা হলে এর আকার কমে আসবে। তখন কর-জিডিপির অনুপাত বেড়ে যাবে।

এনবিআরের কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা ও কর্মদক্ষতা মূল্যায়নের সুসংগঠিত কাঠামো নেই মর্মে যে দাবি করা হয় তা সঠিক নয়। বাংলাদেশে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) হলো একটি কাঠামো যা সরকারি দপ্তরসমূহ তাদের বার্ষিক কর্মসম্পাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা পর্যালোচনার জন্য ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ফলাফলভিত্তিক কার্যক্রম, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং সম্পদের দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এটি চালু করা হয় এবং এটি সরকারি খাতের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারাও এর ব্যতিক্রম নন। সরকারের অন্যান্য সকল দপ্তরের মতো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাগণও তার দপ্তরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) করে থাকে এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন।

এনবিআর সম্পর্কে জনসাধারণের একটি প্রচলিত ধারণা হলো, এটি একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। বাস্তবতা হলো, দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি বিস্তৃত কাঠামোগত সমস্যা, যা শুধু এনবিআর নয়, দেশের প্রায় প্রতিটি খাতেই কোনো না কোনোভাবে বিদ্যমান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের খানা জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালের খাতভিত্তিক দুর্নীতির তালিকায় কর ও কাস্টমসের অবস্থান ছিল ১৪তম, যেখানে ২০২১ সালে এ খাতটি শীর্ষ ১৫-এর বাইরে ছিল এবং ২০১৭ সালে ছিল ১৩তম অবস্থানে। এই চিত্র বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় যে, এনবিআরে দুর্নীতি থাকলেও তা জনমনে প্রচলিত ধারণার বিপরীত। এনবিআর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ গ্রহণ করেছে। যার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, প্রশাসনিক তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এনবিআরের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এই দুর্নীতির অপবাদ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

এনবিআরের সংস্কারের উদ্যোগ, অধ্যাদেশ জারি ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়া

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রয়াসে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে কার্যকর ও টেকসই সংস্কারের লক্ষ্যে খাতভিত্তিক বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এসব কমিশনের প্রতিবেদন ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের পূ‍র্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দল, সংশ্লিষ্ট অংশীজনসহ সূশীল সমাজের প্রতিনিধির আলোচনা চলমান রয়েছে। এই সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশক্রমে যখন রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়, এনবিআরের কর্মকর্তারা এই কমিটিকে সাদরে গ্রহণ করেন। কমিটির পরামর্শকরা আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শক্তিশালী রাজস্ব কাঠামো বিষয়ে সিভিল সোসাইটি এবং এনবিআরের কর্মকর্তাদের মতামত শোনেন, এবং সে অনুযায়ী তাদের উত্তম বিবেচনায় রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের একটি অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন। এই প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়, রাজস্ব নীতি প্রণয়নের কাজ রাজস্ব কমিশন নানক একটি স্বাধীন সংস্থার উপর ন্যস্ত থাকবে এবং এনবিআরের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দক্ষ ও নিবেদিত কর্মকর্তাদেরকে রাজস্ব কমিশনে পদায়ন করা হবে। সুপারিশে বলা হয়, নীতি বাস্তবায়ন ও রাজস্ব আদায়ের কাজ বর্তমানের ন্যয় এনবিআরের উপর ন্যস্ত থাকবে, যা পুনর্গঠিত হয়ে আরো কার্যকর রাজস্ব এজেন্সী হিসেবে উন্নীত হবে।

এছাড়া, রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কাজ পৃথক করে এনবিআরকে বিশ্বমানের একটি রাজস্ব এজেন্সীতে রূপান্তরের উপযুক্ত কাঠামোগত সংস্কারের আরেকটি প্রস্তাব কর এবং কাস্টমস ক্যাডার যৌথভাবে প্রস্তুত করে। দুই ক্যাডারের যৌথ প্রস্তাবটি রাজস্ব সংস্কার পরামর্শক কমিটির প্রস্তাবের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ ছিলো। এর ফলশ্রুতিতে যখন আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রাজস্ব সংস্কারের আলোকিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আশান্বিত হয়েছিলাম, ঠিক তখনই আমরা জানতে পারলাম রাজস্ব সংস্কার কমিটির সংস্কারকে পাশ কাটিয়ে সবার অগোচরে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে আরেকটি খসড়া প্রস্তাব প্রস্তুত হয়েছে। যেই প্রস্তাবের মাধ্যমে কর, কাস্টমস এবং ভ্যাট কর্মকর্তাদের কর্মক্ষেত্র খর্ব হয়ে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে এক তরফাভাবে ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। এই শংকা থেকে আমরা তৎক্ষনাৎ এনবিআরের চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করি এবং এই অধ্যাদেশ জারী হলে দেশের অর্থনীতির জন্য তার ভয়াবহ পরিনতির কথা জানাই। এর পরবর্তী দিনগুলোতে আমরা এনবিআরের চেয়ারম্যান এবং বিসিএস ট্যাক্সেশন ও বিসিএস কাস্টমস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিসহ নির্বাহী সদস্যদের সাথে একাধিক সভা করি। এই সভাগুলোতে এনবিআরের তরুণ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অর্থ উপদেষ্টার সাথে যথাযথ মাধ্যমে সাক্ষাৎ করার দাবিটি বারবার উঠে আসে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে প্রস্তুতকৃত এই খসড়া অধ্যাদেশের অপরীক্ষিত মডেলের কারণে দেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় যে স্থবির অবস্থা সৃষ্টি হবে, অর্থ উপদেষ্টাকে সে বিষয়ে অবহিত করতে আমরা বদ্ধপরিকর ছিলাম। কিন্তু চেয়ারম্যান চরম অসহযোগিতা এবং যোগাযোগের অপর্যাপ্ততার কারণে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষা কিংবা আশংকার কোন কথাই অর্থ উপদেষ্টাকে জানাতে পারিনি।

ফলে এনবিআরের সকল কর্মকর্তাদের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অনির্বাচিত দুই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিরা অর্থ উপদেষ্টার সাথে দেখা করে, রাজস্ব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনের পরিপন্থী একটি মডেল সমর্থন করেন। সেখানে রাজস্ব সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী বিভাগের মর্যাদায় “রাজস্ব কমিশন” নামে একটি স্বাধীন সংস্থা ও পুনর্গঠিত “জাতীয় রাজস্ব বোর্ড” এর পরিবর্তে “রাজস্ব নীতি” এবং “রাজস্ব ব্যবস্থাপনা” পৃথকীকরণের মাধ্যমে দুটি স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়াও নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে রাজস্ব সংস্কার পরামর্শ কমিটির প্রতিবেদনে কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিজ্ঞতাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হলেও পরবর্তীতে অজ্ঞাত ও প্রভাবশালী একটি মহলের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে খসড়াটির নেতৃত্ব সংক্রান্ত ধারায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়, যেখানে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং কিছু ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী বিধানও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে অর্থ উপদেষ্টার সাথে আলোচনার জন্য বারবার চেয়ারম্যান এবং দুই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মহাসচিবকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও তারা আমাদের সেই সুযোগ করে দেননি। যার ফলে আলোচিত অধ্যাদেশ জারি পর্যন্ত তারা আমাদের আশ্বাস দেন যে, অর্থ উপদেষ্টার সাথে আমাদের আলোচনা ব্যতিরেকে অধ্যাদেশ জারি হবে না। তারা আরো দাবি করেন যে, আমাদের মতামতকে তারা অর্থ উপদেষ্টার নিকট যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং সে অনুযায়ী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ করছে। কিন্তু মধ্যরাতে জারি করা এই অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করে আমরা দেখতে পাই, খসড়া প্রস্তুতকালীন দিনগুলোতে আমাদের মতামতকে কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করার তাদের সব আশ্বাস অসত্য ছিলো। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অবিবেচনা ও মিথ্যাবাদিতার ফলস্বরূপ এনবিআরের সকল স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সম্মতিক্রমে, দেশের রাজস্ব কাঠামোকে শক্তিশালী করার ও দেশবাসীকে সত্য উপস্থাপনের তাগিদে ১৩ মে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ গঠিত হয়।

আরো বলা হয়, দেশের সিভিল সোসাইটি, পলিসি থিংক ট্যাংক, মিডিয়াসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সদস্য ইতোমধ্যে আমাদের দাবির সাথে ঐক্যমত পোষণ করে বিবৃতি প্রদান করেছে। উল্লেখ্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে রাজস্ব ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার নামে বিকেন্দ্রীকরনের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন করেছে। এছাড়াও টিআইবির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান স্পষ্টভাবে বলেন যে, ‘অধ্যাদেশে রাজস্ব বোর্ডের বিকেন্দ্রীকরণের নামে সরকারের, বিশেষত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্তৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক উন্নত চর্চা অনুযায়ী, একটি দেশের রাজস্ব নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত পূর্বক স্বতন্ত্র সংস্থা, বোর্ড বা এজেন্সি করা প্রয়োজন, যাতে তা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবের আওতামুক্ত থাকে।’ এছাড়াও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) থেকেও রাজস্ব কাজে অভিজ্ঞ কাউকে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার প্রধান করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে মতামত দেয়া হয়েছে এবং কর জিডিপি বাড়বে এমন কোন উদ্যোগের প্রতিফলন অধ্যাদেশে নেই বলেও জানানো হয়েছে।

স্মারকলিপিতে প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ্যে করে বলা হয়, ২০ মে অর্থ উপদেষ্টার আমন্ত্রণে “এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ” এর ১৩ জন প্রতিনিধি অর্থ মন্ত্রনালয়ে একটি আলোচনা সভায় অংশ নেয়। আমাদেরকে ওই আলোচনা সভায় নিজেদের মতামত ও উদ্বেগ প্রকাশ এবং তার সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হবে বলে সভার আগে আশ্বস্ত করা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। অনাকাঙ্খিত স্বল্প সময়ের মধ্যে আমাদের কথা বলার সুযোগ দেয়া এবং সেই মতামত অর্থ উপদেষ্টা আমলে না নেয়ায় দুঃখজনক হলেও জানাতে হচ্ছে যে, অর্থ উপদেষ্টার সাথে প্রতিনিধি দলের বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি। এই নতুন বাংলাদেশ তরুণদের আকাঙ্ক্ষার উপর দাঁড়িয়ে নতুনভাবে যাত্রা শুরু করেছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বরাবরই তরুণদের উপর আস্থা রেখেছেন। আমরা অনুরোধ করছি, তারই প্রতিফলন হিসেবে রাজস্ব সংস্কার নিয়ে এনবিআরের এই তরুণ অফিসারদের আকাঙ্ক্ষার কথা, বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজস্ব কাঠামো নিয়ে আমাদের স্বপ্নের কথা শুনুন। এছাড়া জারি করা অধ্যাদেশের কোন কোন জায়গায় এনবিআর ও এনবিআরের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আপত্তি রয়েছে-তা তুলে ধরা হয়।

** চেয়ারম্যানের অপসারণসহ ‘অসহযোগ’ কর্মসূচি
** অর্থ উপদেষ্টার ৬-৭ মিনিট-ই ‘আগুন ধরলো’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!