সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধন করে অসদাচরণের কারণে চাকরি থেকে অপসারণ ও বরখাস্তের বিধান তুলে দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর বদলে, পেনশনসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা দিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে কোনো সরকারি কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর বিধান যুক্ত করা হচ্ছে। এ তথ্য জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র।
সূত্র জানিয়েছে, সচিবালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনের পর সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ পর্যালোচনায় গঠিত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এই সংশোধন আনা হচ্ছে। লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের ভেটিং শেষে সরকারি চাকরি (দ্বিতীয় সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫– এর খসড়া গতকাল বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদ চূড়ান্তভাবে অনুমোদন করেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে অধ্যাদেশে কী কী পরিবর্তন আনা হয়েছে, সে বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কোনো তথ্য জানায়নি।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী, বিভাগীয় মামলার মাধ্যমে কোনো কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো সম্ভব হলেও তা সময়সাপেক্ষ। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ সংশোধনের মাধ্যমে এখন দ্রুত সময়ে যেকোনো কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর সুযোগ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পর খসড়াটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের যাচাই শেষে এটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ার পর অধ্যাদেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে সংশোধন করা হবে।
বর্তমান অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র নোটিশ দিয়েই অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে পারেন। তবে সংশোধিত অধ্যাদেশে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার অন্তত একজন সদস্য নারী হতে হবে। তদন্তের আদেশ পাওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে কমিটিকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন না দিলে কমিটির সদস্যদের অদক্ষ হিসেবে গণ্য করে তাদের এসিআরে তা অন্তর্ভুক্ত করা হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া যেতে পারে।
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী, বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কোনো কর্মচারী পেনশন সুবিধা পেলেও এক বছরের অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) ও ১৮ মাসের ছুটি নগদায়নের সুবিধা পান না। এ ছাড়া তিনি সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিয়োগের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হন। তবে সংশোধিত সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের খসড়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো ব্যক্তিকে পিআরএল ও ছুটি নগদায়নের সুবিধা দেওয়া হবে কি না, তা উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত নির্দেশনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
সরকারি চাকরি আইনের ৪৫ ধারা অনুযায়ী, কোনো কর্মচারীর চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে সরকার জনস্বার্থে কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই তাকে অবসরে পাঠাতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিনি পেনশন, অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) এবং ছুটি নগদায়নসহ সব ধরনের আর্থিক সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে গত ২৫ মে সরকার একটি অধ্যাদেশ জারি করে, যেখানে চার ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা ছাড়াই কেবল কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করার বিধান রাখা হয়। এর প্রতিবাদে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলনে নামেন। আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ৪ জুন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়, যারা আন্দোলনকারী কর্মচারী নেতাদের সঙ্গে দুই দিনব্যাপী বৈঠক করেন। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই বর্তমানে অধ্যাদেশটি সংশোধন করা হচ্ছে।
বর্তমান অধ্যাদেশ অনুযায়ী, যৌক্তিক কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সংশোধনীতে এই বিষয়ে নতুন ব্যাখ্যা যুক্ত করা হচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, যদি কেউ ব্যক্তিগত জরুরি প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে শুধু এই কারণেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান বাদিউল কবীর বলেন, ‘অনানুগত্যের ধারাটি বাদ দেওয়া হচ্ছে, যা অধ্যাদেশটির কার্যকারিতা অনেকটাই নাকচ করে দেয়। উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠকেও আমাদের বিষয়টি জানানো হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘কারণ দর্শানোর সুযোগ রাখা, তদন্ত কমিটি গঠন এবং নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে কমিটিতে একজন নারী রাখার যে প্রস্তাব আমরা দিয়েছিলাম, সরকার তা মেনে নিয়েছে। ফলে আমাদের মূল উদ্বেগগুলো অনেকটাই দূর হয়েছে।’
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালার ন্যায়ই বিষয়টি সংশোধন করা হচ্ছে, যাতে অভিযোগ দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়। তবে বর্তমান অধ্যাদেশে আপিল ও রিভিউ ব্যবস্থায় অসংগতি রয়েছে, যা সংশোধন করা হয়েছে কিনা তা দেখতে হবে। তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মতো বিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরতদের জন্য এই অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে না, যা আইন দুই রকম হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর মতে, চাকরি অধ্যাদেশ বাতিল করে সব সরকারি কর্মচারীর বেআইনি আন্দোলন দমনের জন্য আলাদা একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত ছিল।