চট্টগ্রাম বন্দরে ৩৫৭ ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনার

দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর একটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকার আশঙ্কায় একটি কনটেইনার শনাক্ত করা হলেও, বন্দরের অভ্যন্তরে আরও ১২টি কনটেইনার এখনও অবস্থান করছে। এই কনটেইনারগুলো এখনো ইয়ার্ড থেকে সরানো হয়নি। তাছাড়া, বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে ৩৫৭টি কনটেইনারে সালফিউরিক অ্যাসিড, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের মতো বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থও রয়েছে।

এদিকে ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরনো এসব কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাসায়নিক পদার্থ বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। লেবাননের বৈরুতের মতো যে কোনো সময় বিস্ফোরণের আশঙ্কা করছে বন্দরের নিজস্ব কর্তৃপক্ষ। বিপজ্জনক কনটেইনারগুলো সরানোর জন্য তারা চট্টগ্রাম কাস্টমসকে এক ডজনের বেশি চিঠি দিয়েছে। কাস্টমসও বিষয়টি পরমাণু শক্তি কমিশনকে জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। এই চিঠিপ্রেরণের অব্যাহত চলাচলের মধ্যে কনটেইনারগুলো অপসারণ হচ্ছে না, ফলে ঝুঁকিও ক্রমেই বাড়ছে।

১৪ বছরের পুরনো চারটি কনটেইনারে থাকা তরল রাসায়নিক ২০২৪ সালে ইয়ার্ড থেকে খালাস করা হলেও, চিটাগং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এবং ওভারফ্লো ইয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ কনটেইনারগুলো এখনও অবস্থান করছে। এসব কনটেইনারের মধ্যে অনেকটি ভাঙা, কিছুতে পাউডার জাতীয় রাসায়নিক, আবার কিছুতে তরল রাসায়নিক রয়েছে। এদের মধ্যে পাতলা ক্যালসিয়াম কার্বনেট, সালফেট ও সোডিয়াম সালফেট বোঝাই ৯টি কনটেইনার রয়েছে। এছাড়া, ১০ থেকে ২০ বছর ধরে ওভারফ্লো ইয়ার্ডে অতি বিপজ্জনক হিসেবে পরিচিত সালফিউরিক এসিড, জিংক অক্সাইড, পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইড, মিথানল, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড, ফসফরিক এসিড, ইথাইল অ্যাসিটেট এবং কস্টিক সোডা বোঝাই আরও ১৩৪টি কনটেইনার পড়ে আছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকার সন্দেহে ছয় আগস্ট একটি কনটেইনার শনাক্ত করা হলেও, আরও ১২টি কনটেইনার বন্দরে অবস্থান করছে। এর মধ্যে দুটি থেকে এখনও তেজস্ক্রিয় পদার্থ আলাদা করতে পারেনি পরমাণু শক্তি কমিশন। নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আগেই একাধিক চিঠি দিয়েছে। এসব কনটেইনারের মধ্যে আছে আবুল খায়ের গ্রুপের চারটি, কেএসআরএমের দুটি, সিটাডেল গ্লোবাল করপোরেশনের দুটি, মেসার্স সাজ্জাদ হোসেনের একটি, আনোয়ার ইস্পাত লিমিটেডের একটি এবং এসএস স্টিল লিমিটেডের দুটি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে শনাক্ত হওয়া কনটেইনারও রয়েছে। অধিকাংশ কনটেইনারে জিংক অক্সাইড মিশ্রিত পদার্থ ও স্টিলের স্ক্র্যাপ রয়েছে। সর্বশেষ শনাক্ত কনটেইনারের মতো এই ১২টিও আলাদা স্থানে রাখা হয়েছে। তবে কনটেইনার বা সন্দেহভাজন পদার্থ পুরোপুরি অপসারণ না হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর চরম ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, পদার্থ বিজ্ঞানী মাসুদ কামাল বলেন, গবেষণা, চিকিৎসা, শিল্পকারখানা ও ল্যাব পরীক্ষাসহ নানা কাজে তেজস্ক্রিয় উৎস ব্যবহার করা হয়। এই উৎস ব্যবহারের সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। তেজস্ক্রিয় উৎসকে এমন বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয় যাতে এটি বাইরে বের হতে না পারে। দীর্ঘদিন রাসায়নিক পদার্থ পড়ে থাকলে দাহ্য ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। কোনো কারণে তেজস্ক্রিয় উৎস বাইরে চলে গেলে বা রাসায়নিক বিকিরণ ঘটলে তা মানব শরীর এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনতে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র ও সচিব ওমর ফারুক বলেন, তেজস্ক্রিয় ও রাসায়নিক পদার্থবাহী কনটেইনারগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে কিছু কনটেইনার ১০ থেকে ২০ বছরের পুরোনো। এগুলো অপসারণের জন্য আমরা কাস্টমসকে এক ডজনের বেশি চিঠি দিয়েছি। যদিও কিছু কনটেইনার সরানো হয়েছে, বন্দরে এখনও ৩৫০টিরও বেশি বিপজ্জনক কনটেইনার রয়েছে। এর মধ্যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ থাকার সন্দেহযুক্ত পুরনো কনটেইনার ১২টি। শনাক্ত কনটেইনারসহ এগুলো বিশেষ স্থানে আলাদা রাখা হয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে এসব কনটেইনার দ্রুত অপসারণ করা অত্যাবশ্যক।

ব্রাজিল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা একটি কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত হয়েছে। এই কনটেইনারে রয়েছে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরো। প্রাথমিক ও দ্বিতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্রে কনটেইনারের ভেতরে তিনটি রেডিওনিউক্লাইড আইসোটোপ—থোরিয়াম ২৩২, রেডিয়াম ২২৬ এবং ইরিডিয়াম ১৯২—অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। প্রাথমিক পরীক্ষায় তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা এক মাইক্রোসিয়েভার্ট হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি কতটা বিপজ্জনক, তা পরমাণু শক্তি কমিশনকে জানাতে চিঠি দিয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কনটেইনারের তেজস্ক্রিয়তার প্রকৃত মাত্রা পরীক্ষা করে নিশ্চিত করা হবে। বর্তমানে কনটেইনারটি আলাদা করে রাখা হয়েছে।

সর্বশেষ তেজস্ক্রিয় শনাক্ত কনটেইনারের নমুনা পরীক্ষার জন্য কাস্টমস সোমবার চিঠি পাঠিয়েছে, তবে এখনও কেউ বন্দরে এসে নমুনা সংগ্রহ করেনি। কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার মারুফুর রহমান জানান, বন্দরে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণের যন্ত্র ‘মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভ রেডিয়েশন ডিটেকটিভ সিস্টেম’ সন্দেহভাজন কনটেইনারগুলো শনাক্ত করে। এর মধ্যে তিন বছরের পুরনো কনটেইনারও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ২০১১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে এই তেজস্ক্রিয়তা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করা হয়। সতর্ক সংকেত বাজলে কনটেইনারের খালাস স্থগিত করা হয় এবং তা বিশেষায়িত এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে।

তেজস্ক্রিয়তার সন্দেহে সর্বশেষ শনাক্ত হওয়া কনটেইনারটি ব্রাজিল, পানামা, নেদারল্যান্ডস ও শ্রীলঙ্কার বন্দর ঘুরেও কোথাও শনাক্ত হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দরে এসে এটি শনাক্ত হয়। ঢাকার ডেমরার রড তৈরির কারখানা আল আকসা স্টিল মিলস লিমিটেড ব্রাজিল থেকে এই কনটেইনার আমদানি করেছে। তারা পাঁচটি কনটেইনারে মোট ১৩৫ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করেছে, এবং তেজস্ক্রিয়তা সংকেত পাওয়া কনটেইনার এই পাঁচটির একটি। ৩ আগস্ট ‘এমভি মাউন্ট ক্যামেরন’ জাহাজ থেকে জিসিবি টার্মিনালের ৯ নম্বর জেটিতে কনটেইনারটি নামানো হয়। ৬ আগস্ট বন্দরের ৪ নম্বর ফটক দিয়ে খালাস নেওয়ার সময় মেগাপোর্ট ইনিশিয়েটিভের যন্ত্র তেজস্ক্রিয়তা থাকার সংকেত প্রদান করে।

**চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারে তেজস্ক্রিয়তা শনাক্ত

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!