দেশজুড়ে চলমান মূল্যস্ফীতিতে সাধারণ মানুষের জীবিকা যখন কঠিন হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিং সেবায় শুল্ক ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি হতে পারে। বহুল আলোচিত এই শুল্ক পুনর্নির্ধারণ নিয়ে গত ২ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা জুন মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাগিদ দেন। বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, চূড়ান্ত বৈঠনের আগে জুনের শেষদিকে অংশীজনদের কাছ থেকে লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে।
যদিও শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তবে সম্ভাব্য বৃদ্ধির পরিমাণ আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তাদের আশঙ্কা, শুল্ক বাড়লে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ও উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর—তাদের ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চীফ পারসোনেল অফিসার ও মুখপাত্র নাসির উদ্দিন প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধির পক্ষে মত দিয়ে বলেন, ১৯৮৬ সালের পর থেকে এই শুল্ক কাঠামো হালনাগাদ হয়নি। তার মতে, শুল্ক বাড়ালে পরিচালন ব্যয় মেটানো এবং সেবার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে। সংশোধনের এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ৫০টি সেবা প্রভাবিত হবে, যার মধ্যে রয়েছে বন্দর কর, বার্থিং ফি, ফর্কলিফ্ট চার্জ ও অন্যান্য ইউটিলিটি খরচ। তিনি জানান, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে কেবল এ পাঁচটি সেবায় সামান্য পরিবর্তন আনা হলেও, বাকি সব শুল্ক তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে।
বর্তমানে ২০ ফুটের একটি স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার (টিইইউ) হ্যান্ডলিং করতে আমদানিকারকের খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা (১২৩ ডলার)। প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি কার্যকর হলে এই খরচ বেড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তবে বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, আঞ্চলিক তুলনায় চট্টগ্রামের হ্যান্ডলিং চার্জ এখনো অনেক কম। উদাহরণ হিসেবে, কলম্বোতে এক টিইইউ আনলোডিংয়ে ১০০ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭৫ ডলার, আর চট্টগ্রামে তা মাত্র ৪৩.৪০ ডলার। ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর ৫,০৫৫ কোটি টাকা (৪৩০ মিলিয়ন ডলার) আয় করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। একই বছরে উদ্বৃত্ত বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৯৪৮ কোটি টাকা (২৫০ মিলিয়ন ডলার), যা ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি। রাজস্বের এই উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ পরিচালন ব্যয়ের চাপকেই শুল্ক বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে দেখাচ্ছে।
তবে ব্যবসায়ীদের মতে, শুল্ক বাড়ানোর জন্য এখন সময়টা উপযুক্ত নয়। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান মনে করেন, ১৫ শতাংশ হারে সীমিত পরিসরে শুল্ক বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ব্যবসায়িক খাত ইতিমধ্যেই মুদ্রার অবমূল্যায়ন, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারে চাহিদার দুর্বলতার মতো নানা সংকটের মুখে রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অতিরিক্ত শুল্ক চাপালে অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
আমদানিকারকদের মতে, প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি তাদের চলমান সংকটকে আরও তীব্র করে তুলবে। রাশেদ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আক্তার হোসেন জানান, চলতি বছরের মার্চ মাসেই বন্দরের স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বেড়েছে। কাস্টমস জটিলতার কারণে কনটেইনারগুলো প্রায়ই ১০ থেকে ১৫ দিন পর্যন্ত বন্দরেই আটকে থাকে, যেখানে ফ্রি উইন্ডো মাত্র চারদিন। ফলে প্রতিটি কনটেইনারে দৈনিক গড়ে ৪৮ ডলার অতিরিক্ত খরচ হয়, যা মুনাফার মার্জিনে বড় চাপ সৃষ্টি করছে। তার মতে, যদি শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়, তাহলে সেই ব্যয় ভোক্তাদের ওপরই চাপিয়ে দিতে হবে—আমদানিকারকদের পক্ষে তা বহন করা আর সম্ভব হবে না।
রপ্তানিকারকরা, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা শুল্ক বৃদ্ধিতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন। উল্লেখযোগ্যভাবে, দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে এই খাত থেকে। বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক বেলায়েত হোসেন মনে করেন, ধাপে ধাপে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক বাড়ানো যেতে পারে। তবে তার চেয়ে বেশি হলে কাঁচামাল আমদানি ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে, যার প্রভাব পড়বে উৎপাদন খরচে এবং শেষ পর্যন্ত রপ্তানি বাজারেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।
বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের ৯৩ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে হয়। গম, ভোজ্যতেল থেকে শুরু করে ভারী যন্ত্রপাতি পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানির এই বন্দর দেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। তাই হঠাৎ শুল্ক বৃদ্ধি হলে পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়বে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো।