চট্টগ্রাম বন্দরের প্রস্তাবিত নতুন মাশুলের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। রবিবার দিবাগত রাতে প্রকাশিত এ প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়, সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে নতুন মাশুল কার্যকর হবে। সরকারি প্রজ্ঞাপনের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগের তুলনায় গড়ে ৪১ শতাংশ মাশুল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে কনটেইনার পরিবহনে মাশুল সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এখন থেকে প্রতি ২০ ফুট কনটেইনারে অতিরিক্ত ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা মাশুল দিতে হবে। বন্দরের সেবা গ্রহণে এই মাশুল পরিশোধ করতে হবে ব্যবহারকারীদের।
গত ২৪ জুলাই বন্দরের প্রস্তাবিত মাশুল অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে তখন একসঙ্গে গড়ে ৪১ শতাংশ হারে মাশুল বৃদ্ধির বিরোধিতা করে বন্দর ব্যবহারকারীরা। পরবর্তীতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তাদের সঙ্গে এক দফা আলোচনা হলেও আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত গতকাল প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত মাশুলই বহাল রাখা হলো।
মাশুল বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবহারকারীদের মূল আপত্তি হলো—এক লাফে গড়ে ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি পেলে ভোক্তার ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে এবং রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাবে। পাশাপাশি আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে বন্দরের দুটি টার্মিনাল ছাড়া বাকি সব বিদেশি অপারেটরদের হাতে চলে যাবে। ফলে মাশুল বাড়ানোর সুবিধা সবচেয়ে বেশি ভোগ করবে তারা।
মাশুল বাড়ানো নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বন্দর ব্যবহারকারী ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রামের সভাপতি এবং বিজিএমইএ পরিচালক এস এম আবু তৈয়ব বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তৈরি পোশাক খাত। তার মতে, রপ্তানির কাঁচামাল কনটেইনারে আমদানির সময় একবার এবং প্রস্তুত পণ্য রপ্তানির সময় আবারও বাড়তি মাশুল দিতে হবে। অর্থাৎ, একই পণ্যে দুই দফা মাশুল পরিশোধ করতে হবে, যা অযৌক্তিক। অন্যদিকে সরকারের ব্যাখ্যা, ১৯৮৬ সালের পর এই প্রথম বন্দরের মাশুল সমন্বয় করা হয়েছে এবং বাড়ানোর পরও তা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম রয়েছে।
মাশুল কোথায় কতটা বেড়েছে
নতুন মাশুল কাঠামো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতিটি ২০ ফুট কনটেইনার থেকে বন্দর কর্তৃপক্ষ গড়ে ১১ হাজার ৮৪৯ টাকা মাশুল আদায় করে। নতুন হার কার্যকর হলে প্রতিটি কনটেইনারে অতিরিক্ত দিতে হবে গড়ে ৪ হাজার ৩৯৫ টাকা। এতে মোট মাশুল দাঁড়াবে কনটেইনারপ্রতি ১৬ হাজার ২৪৩ টাকা। অর্থাৎ গড়ে প্রতি কনটেইনারে মাশুল ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষিত হিসাবের ভিত্তিতে এই বৃদ্ধি কত হবে—তা নির্ণয় করা হয়েছে। নতুন মাশুল নির্ধারণে ডলারপ্রতি বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ১২২ টাকা। ডলারের দাম বাড়লে মাশুলও বাড়বে, কারণ বন্দর কর্তৃপক্ষ ডলার ভিত্তিক হিসাবেই মাশুল আদায় করে। তবে কনটেইনারের ধরনভেদে খরচে তারতম্য থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, আমদানি কনটেইনারে মাশুল বাড়বে ৫ হাজার ৭২০ টাকা, আর রপ্তানি কনটেইনারে বাড়বে ৩ হাজার ৪৫ টাকা। এ ছাড়া কনটেইনার জাহাজের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রেও আলাদা মাশুল দিতে হবে।
কনটেইনারভিত্তিক মাশুল বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় খাত হলো জাহাজ থেকে কনটেইনার ওঠানো-নামানো। আগে প্রতিটি কনটেইনার ওঠানো বা নামানোর জন্য মাশুল ছিল ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার, যা এখন বাড়িয়ে ৬৮ ডলার করা হয়েছে। ফলে প্রতি কনটেইনারে বাড়তি গুনতে হবে ২৪ দশমিক ৬০ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন হাজার টাকার সমান। এ ছাড়া কনটেইনার পণ্যে প্রতি কেজির মাশুলও বেড়েছে। আগে যেখানে প্রতি কেজিতে গড়ে ১ টাকা ২৮ পয়সা দিতে হতো, সোমবার থেকে কার্যকর হওয়া নতুন হারে এখন দিতে হবে অতিরিক্ত ৪৭ পয়সা।
বাংলাদেশের রপ্তানির প্রায় পুরো অংশই কনটেইনারের মাধ্যমে সমুদ্রপথে সম্পন্ন হয়। একইভাবে শিল্পের কাঁচামাল ও মূল্যবান যন্ত্রপাতিও আসে কনটেইনারে। দেশের আমদানি-রপ্তানির কনটেইনার পরিবহনের ৯৯ শতাংশই হয়ে থাকে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে। ফলে কনটেইনারভিত্তিক মাশুল বৃদ্ধি আমদানি-রপ্তানিতে বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ব্যবহারকারীরা। তবে বন্দর দিয়ে কনটেইনার ছাড়াও সাধারণ পণ্য পরিবহন হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষের হিসাবে, নতুন মাশুল কার্যকর হলে সব ধরনের পণ্যে কেজিপ্রতি মাশুল গড়ে ১৪ পয়সা বাড়বে। বর্তমানে যেখানে প্রতি কেজিতে ৩৫ পয়সা মাশুল দিতে হয়, সেখানে বৃদ্ধি হবে প্রায় ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সাধারণ পণ্যবাহী জাহাজগুলো বন্দর সুবিধা তুলনামূলক কম ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, বাল্ক জাহাজের অধিকাংশই সাগরে নোঙর করে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বন্দরের মোট পণ্যের ৫৯ শতাংশ খালাস হয়েছে বহির্নোঙরে।