** উপকর কমিশনার (বর্তমানে যুগ্ম কর কমিশনার) জাহাঙ্গীরের অনুরোধে অর্ডারশীট তৈরি করেন ইএসিটি মাসুদ
** ট্রাইব্যুনালের আদেশ অমান্য, উপকর কমিশনারের অর্ডারশীট তৈরি করেন ইএসিটি
** উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই মাত্র দুইদিনে কর নির্ধারণ শেষ করেন জাহাঙ্গীর
** ২৬৬ কোটি টাকার কর কমাতে জাহাঙ্গীর ৩০ ও ইএসিটি মাসুদ ৫ লাখ টাকা ঘুস নেন
** শাস্তি হিসেবে ইএসিটি মাসুদ বরখাস্ত, যুগ্ম কর কমিশনার জাহাঙ্গীরকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে
** কর কমানো ও অনিয়মে জড়িত করিম গ্রুপের জোবাইদা করিম জুট মিলস লিমিটেড
ট্যাক্সেস আপীলাত ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। একজনের অর্ডারশীট লিখেছেন আরেকজন। কর নির্ধারণে নেয়নি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন। অনুমোদন না নিয়ে মাত্র দুইদিনে সব কাজ শেষ করেছেন, যা উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন না। কোম্পানির ২৯৯ কোটি টাকার প্রযোজ্য আয়কর কমিয়ে ৩৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৬৬ কোটি টাকা কর কমাতে উপকর কমিশনার (ডিসিটি) ৩০ লাখ ও অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার (ইএসিটি) ৫ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন। উপকর কমিশনার থেকে যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতিও পেয়েছেন। আবার বদলিও হয়েছেন। অত্যন্ত গোপনে ও বদলির সুবাদে তড়িঘড়ি করে কোম্পানি থেকে ঘুস নিয়ে রাষ্ট্রের ২৬৬ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির চেষ্টা করেছেন।
দুইজন অপরাধ স্বীকারও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হননি। বিষয়টি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘আর্থিক সুবিধা বা ঘুস’ নিয়ে রাজস্বের ক্ষতি করা সেই ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একইসঙ্গে সেই উপকর কমিশনার বর্তমানে যুগ্ম কর কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে চাকরি হতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সই করা পৃথক আদেশ জারি করা হয়েছে।
মো. আবদুর রহমান খান সই করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, কর অঞ্চল-১৬, ঢাকার যুগ্ম কর কমিশনার (বর্তমানে কর অঞ্চল নোয়াখালীর পরিদর্শী রেঞ্জ-৩) মো. জাহাঙ্গীর আলম এর চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সরকার জনস্বার্থে তাঁকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা প্রয়োজন মর্মে বিবেচনা করে। সেজন্য সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর ৪৫ ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাঁকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা হলো।
অপরদিকে, ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান এর সাময়িক বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, কর অঞ্চল ফরিদপুরের অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি সংক্রান্ত কাজে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় কার্যধারা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেজন্য মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর বিধি ১২ অনুযায়ী চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। বরখাস্তকালীন তিনি বিধি মোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন।
এনবিআর সূত্রমতে, মো. জাহাঙ্গীর আলম উপকর কমিশনার হিসেবে বিভাগীয় পদোন্নতিপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০২৪ সালের ২১ অক্টোবর কর অঞ্চল-১, চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে কর অঞ্চল-১৮, ঢাকায় উপকর কমিশনার হিসেবে যোগদান করেন। চলতি বছরের ৭ জুলাই উপকর কমিশনার হতে যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন। ১০ জুলাই কর অঞ্চল-১৮, ঢাকা হতে কর অঞ্চল-১৬, ঢাকায় পরিদর্শী রেঞ্জ-৪ তাকে বদলি করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর তাকে কর অঞ্চল নোয়াখালীর পরিদর্শী রেঞ্জ-৩ বদলি করা হয়। আর ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে চলতি বছরের ২০ আগস্ট কর অঞ্চল-১৮, ঢাকা থেকে কর অঞ্চল ফরিদপুরে বদলি করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, কর অঞ্চল-১৮, ঢাকার আওতাধীন করদাতা প্রতিষ্ঠান জোবাইদা করিম জুট মিলস লিমিটেড। করিম গ্রুপের পাটজাত পণ্য রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানটি দুই করবর্ষের ২৯৯ কোটি টাকার কর নির্ধারণ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি ট্যাক্সেস আপীলাত ট্রাইব্যুনালে গেলে ট্রাইব্যুনাল কর রিভাইজ করার নির্দেশনা দিয়ে ওই কর অঞ্চলে প্রেরণ করে। উপকর কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম সংশ্লিষ্ট সার্কেল কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘুসের দেন দরবার করেন। প্রতিষ্ঠানের কর কমিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠান তাঁকে ৩০ লাখ টাকা ঘুস দিতে রাজি হন। জাহাঙ্গীর কর কমানোর পথ খুঁজতে থাকেন। এরই মধ্যে চলতি বছরের ৭ জুলাই তিনি যুগ্ম কর কমিশনার হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে যান। জাহাঙ্গীর ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে ম্যানেজ করেন। নতুন কর অঞ্চলে যোগদান করতে হবে-এই অজুহাতে তড়িঘড়ি করে অর্ডারশীট মাসুদুর রহমানকে দিয়ে তৈরি করান। যদিও একজনের অর্ডারশীট অন্যজন তৈরি করা আইন বর্হিভূত কাজ। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অমান্য করে রিভাইজ না করে উল্টো জাহাঙ্গীর আলম কোম্পানির সঙ্গে ঘুসের দফারফা করে ২৯৯ কোটি টাকার কর ৩৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করেন। কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিনি ওই কর অঞ্চলের রেঞ্জ বা কমিশনারের অনুমোদন নেননি। মাসুদকে দিয়ে অর্ডারশীট তৈরি করে মাত্র দুইদিনের মধ্যে রেঞ্জ বা কমিশনারের অনুমোদন ছাড়াই ব্যাক ডেডে সই করে কোম্পানিকে ২৬৬ কোটি টাকার কর কমিয়ে দেন। বিনিময়ে তিনি কোম্পানি থেকে ৩০ লাখ ও ইএসিটি মাসুদুর রহমান ৫ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন বলে জাহাঙ্গীর স্বীকার করেছেন। তবে মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান ঘুস নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, মো. জাহাঙ্গীর আলমের অনুরোধে তিনি অর্ডারশীট তৈরি করেছেন। তিনি কিছুই জানেন না। জাহাঙ্গীর তাকে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।
সূত্র আরও জানায়, বিষয়টি কর অঞ্চল-১৮, ঢাকার রেঞ্জ ও কমিশনারের নজরে আসে। একইসঙ্গে এনবিআরের নজরেও আসে। পরে করদাতা কোম্পানির ফাইল এনবিআরে নিয়ে আসা হয়। যাচাই শেষে ঘুসের বিনিময়ে কর ২৬৬ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া, ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা অমান্য, একজনের অর্ডারশীট আরেকজন তৈরি, রেঞ্জ ও কমিশনারের অনুমোদন না নেয়ার অভিযোগের সত্যতা পায় এনবিআর। পরে যুগ্ম কর কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলম ও অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুইজনই ঘুসের বিনিময়ে অনিয়ম ও কর কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। এর মধ্যে ইএসিটি মোহাম্মদ মাসুদুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। যুগ্ম কর কমিশনার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে শাস্তি হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। মো. জাহাঙ্গীর আলমের বিরুদ্ধে এর আগেও রাজস্বের ক্ষতি করে ঘুস নেয়াসহ নানান ধরনের অভিযোগ রয়েছে।