ঘুষ-মুক্তিপণের নিরাপদ মাধ্যম মোবাইল ব্যাংকিং

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, ঘুষ, চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণের অর্থ লেনদেনে মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) একটি সুবিধাজনক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মঙ্গলবার (২৭ মে) ঢাকার ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে ‘মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন ডিরেক্টর মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।

গবেষণা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। এই খাতে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ ব্যবস্থা কার্যকর না থাকায় প্রতারক চক্র সহজেই গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করার সুযোগ পাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে এমএফএস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের বর্তমান বা সাবেক কর্মী, এজেন্ট ও পরিবেশকেরা অর্থের বিনিময়ে গ্রাহকের সংবেদনশীল তথ্য জালিয়াত চক্রের কাছে সরবরাহ করছে, কিংবা নিজেরাই এসব প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছে। আবার কিছু চক্র কৌশলে এজেন্ট পয়েন্ট থেকে লেনদেন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

অনেক সময় অন্যের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অনৈতিকভাবে কৌশলে হস্তগত করে নতুন এমএফএস হিসাব খোলার সুযোগ থাকায় প্রতারণা ও জালিয়াতিতে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘুষ, চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণের অর্থ লেনদেনে মোবাইল আর্থিক সেবা একটি সহজ ও নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, এমএফএস লেনদেনের বিবরণী আয়কর রিটার্নে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকায় কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এই ব্যবস্থার অপব্যবহার করে ঘুষ আদান-প্রদান করছেন।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাজী আমিনুল হাসান এবং রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তারা জানান, গবেষণাটি ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত সময়জুড়ে পরিচালিত হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের অংশ হিসেবে দেশের ৩২টি জেলার ১ হাজার ৭৮৪ জন ব্যক্তিগত হিসাবধারী, ৪২৯ জন মার্চেন্ট হিসাবধারী এবং ৬৬৪ জন এজেন্টের ওপর জরিপ চালানো হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের মধ্যে ৬.৩ শতাংশ, এজেন্টদের ১৭ শতাংশ এবং মার্চেন্টদের ১.৬ শতাংশ জানিয়েছেন, তাঁরা জালিয়াতি ও প্রতারণার শিকার হয়েছেন। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যথাক্রমে ৩.৬ শতাংশ, ৮.৭ শতাংশ এবং ১.৪ শতাংশের। প্রতারণায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের ক্ষতির পরিমাণ সর্বনিম্ন ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ হাজার টাকা পর্যন্ত। এজেন্টদের ক্ষতি হয়েছে ২০০ টাকা থেকে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পর্যন্ত, আর মার্চেন্টদের ৫৩ টাকা থেকে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

প্রতারণার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ ক্ষেত্রে গ্রাহককে প্রলোভন বা ভুয়া তথ্য দিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে। ৪২ শতাংশ ক্ষেত্রে ফোন কল বা এসএমএসের মাধ্যমে প্রতারণা ঘটেছে, আর ১২ শতাংশ ঘটনায় হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েও থানায় মামলা বা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মাত্র ৭ শতাংশ ব্যক্তি হিসাবধারী, ২৭ শতাংশ এজেন্ট এবং ৪ শতাংশ মার্চেন্ট।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’ নির্ধারিত আইনি কাঠামো অনুসরণ না করেই পরিচালিত হচ্ছে। গবেষণা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালের বিধিমালা অনুযায়ী ব্যাংকের বাইরে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এমএফএস প্রদানকারী হিসেবে নিবন্ধন নিতে বা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এই বিধান অমান্য করে ডাক বিভাগের ডিজিটাল সেবা ‘নগদ’-কে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেয়। এছাড়া বিধিমালা অনুযায়ী, শুধু অবকাঠামো গঠনের জন্য অনাপত্তিপত্র নেওয়ার অনুমতি থাকলেও ‘নগদ’ সেই সুযোগে গ্রাহক অন্তর্ভুক্তিসহ সব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়নি।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল আর্থিক সেবা গ্রহণে ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের ১৪ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হন। পুরুষ হিসাবধারীদের তুলনায় নারীরা বেশি সমস্যা ভোগেন। অভিযোগ করা গ্রাহকদের মধ্যে ৬১.৯ শতাংশই তাদের সমস্যার সমাধান পাননি।

বিধি না থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক ডাক বিভাগকে ‘নগদ’ পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী লাইসেন্স দিয়েছে এবং ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সাবসিডিয়ারি গঠনের শর্তে ছয়বার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে, যা এখনও চলমান। টিআইবি মনে করে নগদের পরিচালনায় আইনি কাঠামো মানা হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাক বিভাগ সাবসিডিয়ারি গঠন না করে ‘থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড’-এর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে নগদ পরিচালনা করছে, যা বিধিমালা লঙ্ঘন। এছাড়া, ডাক বিভাগের অনুমতি ও অংশগ্রহণ ছাড়া ‘নগদ’ নিজেই সেবামূল্য নির্ধারণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!