গ্রহণযোগ্য ২ শতাংশ সীমা ছাড়িয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গ্যাস বিতরণ লাইনে গড়ে ৬.২৮ শতাংশ গ্যাস অপচয় হয়েছে, যার ফলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছর ২০২৪-২৫–এর মার্চ পর্যন্ত অপচয়ের হার বেড়ে হয়েছে ৭.৪৪ শতাংশ, যাতে ক্ষতি হয়েছে আরও প্রায় ৩ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এর বাইরে গ্যাস সঞ্চালন লাইনে অতিরিক্ত ২ শতাংশ অপচয় হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পেট্রোসেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়, গণমাধ্যমের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে এই তথ্য উপস্থাপন করে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে কারিগরি ত্রুটির কারণে কিছু গ্যাসের অপচয় হয়, যাকে সিস্টেম লস বলা হয়। যদিও এর স্বাভাবিক হার সর্বোচ্চ ২ শতাংশ হওয়া উচিত, দেশে এই হার অনেক বেশি। অতিরিক্ত অপচয়ের মূল কারণ হিসেবে গ্যাস চুরি উল্লেখ করা হয়েছে, যা সিস্টেম লস হিসেবে গোপনে চলে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
গ্যাসের অপচয় ও চুরি রোধে দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। দেশের গ্যাস খাতের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে সেমিনারে মূল নিবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমে গেছে, যা এখন প্রায় ১৫ বছর আগের স্তরে নেমে এসেছে। গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজন মতো অনুসন্ধান কার্যক্রম না হওয়ায় আজ গ্যাস সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কূপ খনন বাড়ানো উচিত, না হলে আমদানি ছাড়া গ্যাস সংকট মোকাবেলা কঠিন হবে। গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধানে বেশি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
ড. ইজাজ আরও বলেন, গ্যাস চুরি ও অপচয় কমানোর জন্য তৎপর হতে হবে। সঞ্চালন ও বিতরণ মিলে কারিগরি ক্ষতি প্রায় ১০ শতাংশ, যা অত্যন্ত বেশি। সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতি কখনোই ২ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি ভালোভাবে যাচাই করা প্রয়োজন।
সেমিনারে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো. রেজানুর রহমান বলেন, সঞ্চালন লাইনে কারিগরি ক্ষতির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। অবৈধ সংযোগ বন্ধে পেট্রোবাংলা তৎপর রয়েছে এবং কোনো অবৈধ সংযোগ শনাক্ত হলেই তা অবিলম্বে বিচ্ছিন্ন করা হবে।
গ্যাস অনুসন্ধান ও এলএনজি আমদানি পরিকল্পনা
জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সকে আরও সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি, আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য নতুন টার্মিনাল নির্মাণে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে স্থলভাগের টার্মিনাল স্থাপনের ক্ষেত্রে। মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকায় এই টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এটি সম্পন্ন হলে কম দামের সময় বাড়তি এলএনজি কেনা ও মজুদ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে এসব কাজ রাতারাতি সম্ভব নয় এবং এতে প্রায় পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে।
সর্বোচ্চ বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে
গত অর্থবছরে পেট্রোবাংলার রাজস্ব আয় ছিল ৫৪ হাজার ১১৭ কোটি টাকা, যার প্রায় অর্ধেকই বকেয়া রয়েছে। গত মে মাস পর্যন্ত গ্যাস বিলের বকেয়া দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ১৯৯ কোটি টাকায়, যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। বকেয়া ১৩ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে নেমে এলে তা সন্তোষজনক হবে। সর্বোচ্চ বকেয়া বিদ্যুৎ খাতে রয়েছে, যার পরিমাণ ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। তারপরে সার কারখানায় ৯৬৪ কোটি টাকার বকেয়া রয়েছে। তবে পেট্রোবাংলার কোনো বিদেশি কোম্পানির কাছে বকেয়া নেই; সব বিল শোধ হয়ে গেছে। পেট্রোবাংলা জানিয়েছে, এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটি লোকসান চলছে এবং প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি গ্রহণ করছে।