মাসব্যাপী জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে বুধবার (১৬ জুলাই) জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গোপালগঞ্জে কর্মসূচি পালনে গেলে সেখানে দফায় দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলাকে কেন্দ্র করে দিনভর হামলাকারী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময়, ককটেল বিস্ফোরণ, সংঘর্ষ এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে যুবলীগের এক সদস্যসহ চারজন নিহত হন এবং পুলিশ ও সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হন। এনসিপি নেতাদের দাবি, হামলাগুলো চালায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গোপালগঞ্জ জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। পাশাপাশি আজ রাত ৮টা থেকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় জেলা শহর ও আশপাশের এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে গোপালগঞ্জে হামলার পর জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় নেতারা মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে আজকের কর্মসূচি স্থগিত করে খুলনায় চলে যান। তবে আগামীকাল ফরিদপুরে তাঁদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি যথারীতি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
সংঘর্ষে নিহত চারজন হলেন গোপালগঞ্জ জেলা শহরের উদয়ন রোডের যুবলীগ সদস্য দীপ্ত সাহা (২৫), থানাপাড়ার রমজান কাজী (২৪), সদর উপজেলার আড়পাড়া এলাকার ইমন তালুকদার (১৮) এবং টুঙ্গিপাড়া উপজেলার সোহেল মোল্লা (৪৫)। গোপালগঞ্জ আড়াই শ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শেখ মো. নাবিল সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নিহতদের সবাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান জানিয়েছেন, এনসিপির পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে জেলার সব জায়গায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পরে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় আজ রাত ৮টা থেকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পরিস্থিতি।
গাছ ফেলে সড়ক আটকে, আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ
প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার উলপুর এলাকায় সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা, যাদের সংগঠন বর্তমানে নিষিদ্ধ। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছালে অবরোধকারীরা তাদের গাড়ি ভাঙচুর করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তিন পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ঘটনাস্থলে গেলে তাঁর গাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়।
গোপালগঞ্জ সদরের ইউএনও এম রকিবুল হাসান জানান, ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়ার সময় সদর উপজেলার কংশুর এলাকায় পৌঁছালে তাঁর গাড়িতে হামলা করে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় গাড়ির চালক আহত হন।
এদিকে গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কের বিভিন্ন স্থানে গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে অবরোধ করা হয়। হামলার ঘটনায় আহত পুলিশের তিন সদস্য হলেন সদর উপজেলার গোপীনাথপুর পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক আহমেদ বিশ্বাস, কনস্টেবল কাওছার ও মিনহাজ। তাঁদের গোপালগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে, আমরা এখন পর্যন্ত জানি না। এতে পুলিশের তিনজন সদস্য আহত হয়েছেন এবং একটি গাড়ি পুড়ে গেছে। আহত তিন পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান পিয়ালের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া সড়কের কাঠি এলাকায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তাঁরা বিভিন্ন স্থানে বড় বড় গাছ ফেলে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ চালিয়ে যান। একইভাবে কোটালীপাড়াতেও আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে অংশ নেন। এতে গোপালগঞ্জজুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও এপিবিএনের সদস্যরা টহল জোরদার করে। এদিন বেলা ১১টায় গোপালগঞ্জ পৌর পার্কে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশের কথা থাকলেও পথে পথে বাধার কারণে নেতা-কর্মীদের সেখানে পৌঁছাতে বিলম্ব হয়। পরে সমাবেশস্থলে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়।
হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে: নাহিদ
বাধার মুখেও বেলা দুইটার দিকে গোপালগঞ্জ সদরে সমাবেশ মঞ্চে এসে পৌঁছান এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে সমাবেশে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, সমাবেশস্থলে হামলার উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি ও দেশ গড়ার আহ্বান জানাতে গোপালগঞ্জে এসেছি। মুজিববাদ ও সন্ত্রাসীদের হাত থেকে এই জেলাকে মুক্ত করতে হবে।’
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘ককটেল বিস্ফোরণ ও হামলা করে হিংস্র সন্ত্রাসীরা আমাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে তওবা করার সুযোগ দিয়েছে। জনগণের জীবন বিপন্ন করতে চাইলে মানুষ ছেড়ে দেবে না।’ তিনি বলেন, মুজিববাদ ও মুজিববাদী সংবিধান দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। তাই মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা করতে হবে।’
পদযাত্রায় হামলা
বেলা আড়াইটার দিকে এনসিপি তাদের কর্মসূচি শেষ করে পদযাত্রা শুরু করলে শহরের লঞ্চঘাট এলাকায়, গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে আবারও হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় জনতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাহিনীর সদস্যরা রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোড়ে। একপর্যায়ে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরো শহরজুড়ে।
জেলা কারাগারে হামলা
একপর্যায়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় জনতা গোপালগঞ্জ জেলা কারাগারে হামলা চালায় এবং কারাগারের প্রধান ফটক ভাঙার চেষ্টা করে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তা প্রতিহত করেন। এ পরিস্থিতিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা নিরাপত্তার স্বার্থে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এনসিপির নেতা-কর্মীদের একত্র করে সেনাবাহিনীর পাহারায় মোল্লারহাট সেতু পার করে বাগেরহাটের সীমানায় পৌঁছে দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব, না হয় ফিরব না: সারজিস
সমাবেশে হামলার পর এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমরা যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি, তাহলে মুজিববাদের কবর রচনা করেই ফিরব, না হলে ফিরে যাবো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘গোপালগঞ্জে খুনি হাসিনার দালালরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে নাটক করছে ও পিছু হটছে। সারা বাংলাদেশের মানুষ গোপালগঞ্জে ছুটে আসুন এবং গোপালগঞ্জের বিবেকবান ছাত্র-জনতা জেগে উঠুন। আজই দালালদের কবর রচনা করার শেষ দিন।’
এদিকে পুলিশ সদর দফতরে অবস্থান করে গতকাল গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি তদারকি ও নির্দেশনা দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। পুলিশ সদর দফতরের সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ফেসবুক পোস্টে বলেছেন, ‘নিষিদ্ধ সংগঠনের সন্ত্রাসীদের… ভেঙে দেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, ১ জুলাই থেকে ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পরিচালনা করছে এনসিপি। ইতোমধ্যে দলটি দেশের বিভিন্ন জেলায় এ কর্মসূচি পালন করেছে।