বিগত সরকারের সময় গুমের ঘটনায় সেনাবাহিনীর কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে—এ কথা জানিয়েছে সেনা সদরদপ্তর। বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে এক সংবাদ সম্মেলনে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম জানান, ডেপুটেশনে থাকা সেনাসদস্যরা সরাসরি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকেন না। তবে ডেপুটেশনে থাকা কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, এবং সেগুলোর তদন্ত চলছে।
এই তদন্তে যদি গুমের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তা হলে অবশ্যই সেনাবাহিনী তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে বাংলদেশ সেনাবাহিনী সব ধরনের সহযোগিতা করেছে এবং ভবিষ্যতেও সহযোগিতা থাকবে। ভুক্তভোগী কোনো পরিবার সহযোগিতা চাইলে, তাদেরও সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন এই সেনা কর্মকর্তা।আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে গতবছর অগাস্টে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে সরকার।‘গুমের’ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর মধ্যে কার কী ভূমিকা ছিল, তা গত ৪ জুন জমা দেওয়া কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, গুমের অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে। গুমের শিকার ব্যক্তি, তাঁদের পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী—পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে এসব ঘটনার ‘মূল দায়ী’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গুমের ঘটনায় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কিছু কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার ‘সত্যতা’ পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই একাধিক ‘ব্ল্যাক সাইট’ পরিচালনা করত। এর মধ্যে সবচেয়ে কুখ্যাত ছিল ‘আয়নাঘর’ নামের একটি গোপন কেন্দ্র, যেখানে বন্দিদের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখে নির্মম নির্যাতন চালানো হতো।
গত সরকারের সময়ে ‘আয়নাঘর’ নামে কুখ্যাত তিনটি গোপন বন্দিশালা গত ১২ ফেব্রুয়ারি পরিদর্শন করেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া জাতিসংঘের ‘গুম’ বিষয়ক কার্যনির্বাহী দলের (ডব্লিউজিইআইডি) ভাইস চেয়ারপারসন গ্রাজিনা বারানোভস্কার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল চলতি বছরের জুন মাসের মাঝামাঝি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
সাক্ষাতে গ্রাজিনা বারানোভস্কা র্যাব, ডিজিএফআই ও বিজিবিসহ বিভিন্ন সংস্থায় অতীতে কর্মরত কিছু সেনা সদস্যের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জবাবে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, এসব সেনা সদস্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার অধীনেই দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা সেনাবাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিলেন না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিচারপ্রক্রিয়া ও মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
এরপর ১৯ জানুয়ারি গুম-সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানান, ডিজিএফআই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয় এবং সরাসরি প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে রিপোর্ট করে। আর বাংলাদেশে সাধারণত প্রধানমন্ত্রীই প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই কাজ করতেন।
এনএসআই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে পরিচালিত হলেও, এটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় নয়। এ প্রসঙ্গে অনুসন্ধান কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ইনস্টিটিউশন হিসেবে সেনাবাহিনী এসব ঘটনায় সরাসরি দায়ী নয়—এটি সত্য। তবে ডিজিএফআই, এনএসআই এবং বিশেষ করে র্যাবের যেসব কর্মকর্তারা কমান্ডিং পদে ছিলেন, তাদের বড় একটি অংশই ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য, যাঁরা সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী কিংবা নৌবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে নিয়োগ পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, তারা মূলত সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা হলেও সেই সময় অন্য সংস্থার অধীনে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ফলে তাদের কমান্ড কাঠামো ছিল ভিন্ন।
এ সময় কমিশনের সদস্য নূর খান মন্তব্য করেন, এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তারা জানত না—এ কথা বলার সুযোগ নেই। কারণ একজন সাবেক সেনাপ্রধান প্রকাশ্যে বলেছেন, তার কাছে দুজন সেনা সদস্য আশ্রয় চেয়েছিলেন, যারা এই ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে চাননি। এই বক্তব্যের পর আর অজ্ঞতা দেখানোর সুযোগ নেই। তবে চেয়ারম্যান মইনুল ইসলাম আবারও জোর দিয়ে বলেন, প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী এসব কর্মকাণ্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত ছিল না।