মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে রাজধানীর উত্তরায় এবং গাজীপুরের টঙ্গীতে গণপিটুনির দুটি ঘটনা ঘটে। উক্ত ঘটনাগুলোর মধ্যে তিন ব্যক্তিকে ‘ছিনতাইকারী’ সন্দেহে স্থানীয়রা দলবদ্ধভাবে পেটাতে শুরু করেন। উত্তরা হাউসবিল্ডিং এলাকার বিএনএস সেন্টারের সামনে মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে দুই ব্যক্তিকে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটিয়ে আহত করার পর পায়ে দড়ি বেঁধে পদচারী সেতুর সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মো. নাজিম (৪০) ও মো. বকুল (৩০) নামের ওই দুই ব্যক্তিকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করে।
উত্তরার ঘটনায় কারও প্রাণ যায়নি। কিন্তু টঙ্গীতে ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটুনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ১০টার দিকে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে এ ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে নিহত ওই যুবকের নাম-ঠিকানা জানাতে পারেনি পুলিশ।
দুটি ঘটনা অত্যন্ত বীভৎস ছিল, এবং এসব গণপিটুনির ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। উত্তরার ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন এক ব্যক্তিকে উঁচু করে ধরছে, তার পায়ে দড়ি বাঁধা এবং তাকে পদচারী সেতুর লোহার খুঁটির সঙ্গে উল্টো করে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, হলুদ রঙের টি-শার্ট পরা এক যুবকের মাধ্যমে। এমন নির্বিচার গণপিটুনি এবং এতে হত্যার ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে বিগত ছয় মাসে গণপিটুনির ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, গণপিটুনি বেড়ে যাওয়ার ঘটনা আইনশৃঙ্খলার অবনতির চিত্রকেই তুলে ধরে। দিনের পর দিন এসব ঘটনা বাড়লেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করছেন এসব ব্যক্তি।
দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকারকর্মীদের সংগঠন সাউথ এশিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের (সাহার) বাংলাদেশ ব্যুরো সদস্য সাঈদ আহমেদ বলেন, গণপিটুনির বৃদ্ধি আইন প্রয়োগ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা প্রতিফলিত করে। কয়েক বছর ধরেই এই আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে তিনি বলেন, আস্থাহীনতার কারণে কোনো গণপিটুনিকেই সমর্থন করা উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, যদিও আস্থাহীনতা রয়েছে, তবে তা যথাযথ আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সরকার সে পথে এগোয়নি।
কত মৃত্যু ?
মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের (২০২৪) আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত গণপিটুনিতে ১২১ জন নিহত হয়েছেন।আরেক মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে গণপিটুনিতে সর্বোচ্চ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে গত বছর। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হন ১৪৬ জন, যা আগের বছরের প্রায় তিন গুণ। ২০২৩ সালে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন।
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, গত ৫ আগস্টের পর ‘মব ভায়োলেন্স’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার সহিংসতার পরিমাণ বেড়ে গেছে। সরকার তা বন্ধ করতে তেমন পদক্ষেপ নেয়নি। কখনো কখনো কাউকে জোর করে কোনো পদ থেকে নামিয়ে দেওয়াসহ নানাভাবে ‘মবের’ সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এ কারণেই বেড়েছে এসব মবকেন্দ্রিক সহিংসতা বা গণপিটুনি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মো. সাইদুর রহমান জানান, গণপিটুনির মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, পরিকল্পিত উসকানির কারণে এটি ঘটছে, যেখানে সরকারের সহযোগী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী সক্রিয়ভাবে ইন্ধন দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা একটি বড় কারণ, যা সম্ভবত ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়েছে। তৃতীয়ত, সরকারের উদাসীনতা এবং কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের অনীহার কারণে গণপিটুনির প্রবণতা বাড়ছে।
গণপিটুনি আইনের দৃষ্টিতে ‘হত্যা’
উত্তরা ও টঙ্গীতে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনার পেছনে অপরাধের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং সাধারণ মানুষের অতিষ্ঠ হয়ে পড়ার বিষয়টি জড়িত বলে মনে করছেন কিছু বিশেষজ্ঞ। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে ডাকাতি ও দস্যুতা (ছিনতাই) সংক্রান্ত ১,১৪৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ডাকাতি ও দস্যুতা আরও বেড়েছে। গত জানুয়ারিতে ২৪২টি মামলা হয়েছে, যা গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ৬৯ শতাংশ বেশি। ডিসেম্বরে মামলার সংখ্যা ছিল ২৩০টি, যা আগের বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় ৭০ শতাংশ বেশি।
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, অপরাধের শিকার হওয়ার ভয় থেকে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে, তবে এটি ঠেকাতে হলে অপরাধ দমন করতে হবে এবং যারা আইন নিজের হাতে নেন, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, গণপিটুনি আইনগত দৃষ্টিতে ‘হত্যা’ হিসেবে বিবেচিত হয় এবং এতে জড়িতদের হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি জানান, দীর্ঘদিনের অগণতান্ত্রিক পরিবেশ, গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, প্রশাসনে অস্থিতিশীলতা এবং আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা গণপিটুনি বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
শাহদীন মালিক বলেন, গণপিটুনি এখন বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের চাকরি ও বদলি নিয়ে চিন্তিত, আর আমলাতন্ত্রও যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আমি বলছি না যে প্রশাসনের অপরাধীদের বিচার করা সম্ভব নয়, তবে যদি প্রশাসনিক শৃঙ্খলা এমন দুরবস্থায় থাকে, তাহলে ভালো কিছু করা সম্ভব নয়।