খেলাপি ঋণ গোপন করে নির্বাচনে সুযোগ

সাউথইস্ট ব্যাংক খেলাপি ঋণ গোপন রেখে আওয়ামী লীগের তিন প্রার্থী সাবের হোসেন চৌধুরী, মোরশেদ আলম ও মামুনুর রশিদ কিরণকে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। তারা সবাই এমপি নির্বাচিত হন। একইভাবে, বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক আবু নোমান হাওলাদারের খেলাপি ঋণ গোপন রাখা হয়েছে, ফলে তিনি এখনও পরিচালক পদে রয়েছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে ভয়াবহ এ অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর সঙ্গে জড়িত সাউথইস্ট ব্যাংকের কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপির তথ্য লুকানোর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। অনিয়মের বিষয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাখ্যা চেয়ে গত ১৩ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ১২ মার্চের মধ্যে দফা ধরে ধরে ব্যাখ্যা দিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপির তথ্য হালনাগাদ করার ক্ষমতা ব্যাংকের হাতে তুলে দেওয়ার পর সাউথইস্ট ব্যাংক নির্বাচনের আগে তিন সংসদ সদস্য প্রার্থীর খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন করেছে। এই নিয়মবহির্ভূত কাজের ফলে তারা সংসদে প্রার্থী হতে সক্ষম হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, এই ধরনের অনিয়ম অন্যান্য ব্যাংকগুলিতেও ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রতিষ্ঠান পারফরম্যান্স মোটরসের সাউথইস্ট ব্যাংকের ৩৪টি মেয়াদি ও একটি চলতি মূলধন ঋণ রয়েছে, যার মোট পরিমাণ ৪৮৫ কোটি টাকা। নির্বাচনের আগে এই ঋণ খেলাপি হলেও তা নিয়মিত দেখানো হয়। ঋণটি যথাযথ শ্রেণীকরণ হলে সাবের হোসেন চৌধুরী সংসদ সদস্য পদ ধরে রাখতে ঋণ পরিশোধ করতেন। এছাড়া, ঋণের জন্য যথাযথ প্রভিশন রাখা হয়নি এবং চলতি মূলধন ঋণ ব্যবসায় না খাটিয়ে সহযোগী প্রতিষ্ঠানে পুনঃতপশিলের ডাউনপেমেন্ট হিসেবে দেওয়া হয়েছে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী-২ আসনের সাবেক এমপি মোরশেদ আলম বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান। এ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার ইউটিলিটির সাউথইস্ট ব্যাংকে ৭ কোটি ১২ লাখ টাকার ঋণ ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ছিল। এ তথ্য গোপন করে সিআইবিতে ‘ক্লিন’ রিপোর্ট দেয় ব্যাংক। এভাবে মোরশেদ আলমকে অনৈতিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

নোয়াখালী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মামুনুর রশিদ কিরণের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান এএসটি বেভারেজ ছিল সাউথইস্ট ব্যাংকের ঋণখেলাপি। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। ব্যাংকটির নিউ ইস্কাটন শাখায় তাদের ঋণ খেলাপি হয় বেশ আগেই। সিআইবিতে এ তথ্য গোপন করায় তিনি নির্বাচনের সুযোগ পান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা ও বেঙ্গল ব্যাংকের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মো. আবু নোমান হাওলাদারের মালিকানাধীন ডায়নামিক কারসের ১৩ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যাংকটির প্রিন্সিপাল শাখার খেলাপি। এ তথ্য গোপন রাখায় ঋণখেলাপি হয়েও তিনি এখনও ব্যাংকের পরিচালক পদে বহাল আছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। এসব ব্যক্তির শ্রেণীকৃত ঋণকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সিআইবিতে নিয়মিত হিসেবে রিপোর্ট করা হয়, যা অনৈতিক। খেলাপি ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সঙ্গে জড়িত শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এসব ঋণ খেলাপি করে যথাযথ প্রভিশন রাখতে বলা হয়েছে।

সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুদ্দিন মো. ছাদেকের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। গত মঙ্গলবার থেকে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করা হলেও তিনি উত্তর দেননি। বৃহস্পতিবার তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা জানান, তিনি বোর্ড মিটিংয়ে আছেন এবং রাত ৯টায় ফোনে কথা বলবেন, কিন্তু ফোনে সাড়া দেননি। পূর্বের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম কামাল হোসেনও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি, তবে তিনি বলেন যে, তিনি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না।

সাউথইস্ট ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আলমগীর কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। তাঁর বাসায় গিয়ে জানানো হয়, তিনি দেশের বাইরে আছেন এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায়ও অংশ নেননি। হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠানোর পরও তিনি সাড়া দেননি, তবে তাঁর প্রতিনিধি একসময় দেখা করে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়ার কথা বলেন, কিন্তু পরে আর যোগাযোগ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, সাউথইস্ট ব্যাংকের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে এবং তাদের জবাব পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চেয়ারম্যানের পদ হারিয়েও রেখেছেন দুই গাড়ি
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ব্যাংকের একটি গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। আলমগীর কবির সাউথইস্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দীর্ঘদিন ধরে দুটি করে দামি গাড়ি ব্যবহার করে আসছেন। গাড়ি দুটির একটি হ্যারিয়ার জিপ, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৮৭১৩। আরেকটি মার্সিডিজ, যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-ভ ১৪-০০৫৪। গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি আর চেয়ারম্যান নেই। অথচ গত মঙ্গলবার গুলশান-২ এ ৫৮ নম্বর রোডের ৩/৪ বাসার গ্যারেজে গাড়ি দুটি পড়ে থাকতে দেখা যায়।

সাউথইস্ট ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে একটি গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ ছিল, তবে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। পদ হারানোর চার মাস পরেও তিনি গাড়ি দুটি ফেরত দেননি। গত সপ্তাহে তাঁকে গাড়ি ফেরত দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে এবং দ্রুত ফেরত না দিলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!