কাস্টমসে মিথ্যা-ভুল ঘোষণার জরিমানা অর্ধেক হচ্ছে

বাজেট ২০২৫-২৬

** আইজিএম-এ ভুলের ৫০ শতাংশ জরিমানার বিধান বাতিল করা হচ্ছে
** জাহাজ কোম্পানির কার্গো ঘোষণায় ভুলের জন্য ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকার জরিমানা বাতিল হতে পারে
** কর মামলায় সুদের লাগাম টানা হচ্ছে, সর্বোচ্চ দুই বছরের সুদ আরোপ করা যাবে
** সরকারি ট্রেজারি বন্ডের উৎসে কর দ্বিগুণ করা হচ্ছে
** নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার সহনীয় রাখতে স্থানীয় ঋণপত্রের উৎসে কর কমানো হচ্ছে
** নতুন করদাতাদের আয়ভেদে সর্বনিম্ন আয়কর এক হাজার টাকার বিধান আয়কর আইনে যুক্ত হচ্ছে
** করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয়ে প্রভাব পড়ার শঙ্কা
** আমদানি সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের করের আওতায় আনতে দেড় শতাধিক পণ্যে এআইটি বসছে

আর তিনদিন পরই ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে। এই বাজেটে ব্যবসার প্রসার ও করদাতাদের কষ্ট লাঘবে থাকছে পদক্ষেপ। এছাড়া আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস আইনের দীর্ঘদিনের সমস্যা দূর করা উদ্যোগ থাকছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর বাড়লেও শর্ত শিথিল থাকবে। ব্যবসায়ীরা আইনের পরিবর্তনকে নীতিগতভাবে ইতিবাচক স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, কার্যকর বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে এর প্রকৃত সুফল। আসন্ন বাজেটে যে পরিবর্তন আসতে পারে-তা তুলে ধরা হলো।

মিথ্যা-ভুল ঘোষণায় জরিমানা ২০০ শতাংশ করা হচ্ছে

পণ্য আমদানিতে অনেক সময় মিথ্যা ঘোষণা দেওয়া হয়। আবার কখনো ভুলবশত ঘোষণা দেওয়া হয়, কখনো এইচএস কোডের ভুলের কারণেও মিথ্যা ঘোষণা হয়ে যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের ভুলের কারণকে কাস্টমস মিথ্যা ঘোষণা হিসেবে উল্লেখ করে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত মিথ্যা ঘোষণা ধরা হয় এইচএস কোড জটিলতাকে। গত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ীরা এইচএস কোডের ফাঁদে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন। ভুল বা মিথ্যা ঘোষণা-যাই হোক না কেন, প্রতিষ্ঠিত হলেই জরিমানা সর্বোচ্চ ৪০০ শতাংশ। এই জরিমানার বিধান বাতিল বা জরিমানা কমানোর জন্য প্রকৃত ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা বলছেন, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের জন্য এই জরিমানা গলার কাঁটা। অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য হলে ঠিক আছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমদানিতে ‘ভুলের খেসারত’ হিসেবে ব্যবসায়ীদের মিথ্যা ঘোষণার তকমার সঙ্গে সর্বোচ্চ জরিমানা দিতে হয়। আগামী বাজেটে এই জরিমানার বিধান শিথিল করার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে জরিমানা অর্ধেক অর্থাৎ ২০০ শতাংশ করা হচ্ছে। যার ফলে ছোট-খাটো ভুল বা অসাবধনতাবশত ভুলের ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা হয়রানি থেকে বাঁচবেন। তবে অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি নজরদারি বেশি থাকবে।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আমদানি ঘোষণায় ভুলের জন্য জরিমানা কমানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ জরিমানা এখনও অত্যধিক, বিশেষত বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত রপ্তানিকারকদের জন্য। অনেক সময় এইচএস কোডে সামান্য ভুল হয় বা কাস্টমস কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে ‘মিথ্যা ঘোষণা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি যদি কাঁচামালটি প্রকৃতপক্ষে রপ্তানির উদ্দেশ্যেও আমদানি করা হয়ে থাকে। প্রকৃত দোষীদের চিহ্নিত করতে একটি কার্যকর ব্যবস্থা থাকা জরুরি, কারণ অনেক সময় প্রতারণামূলকভাবে ঘোষণা দেওয়া ব্যবসার বদলে বৈধ ব্যবসারাই বেশি জরিমানার মুখে পড়েন।

সরকারি ট্রেজারি বন্ডের উৎসে কর দ্বিগুণ করা হচ্ছে

অনেক মধ্যবিত্ত নিরাপদ বিনিয়োগের জন্য সরকারি ট্রেজারি বিল কেনেন। আগামী বাজেটে এই ট্রেজারি বন্ডের উৎসে কর দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এর ফলে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকার যে বন্ড বাজারে ছাড়ে তাকে ট্রেজারি বন্ড বা সরকারি সিকিউরিটিজ বলে। বন্ডের ক্রেতা হচ্ছেন ঋণদাতা। আর বন্ড ইস্যুকারী ঋণগ্রহীতা। শেয়ারের মতো বন্ডেরও প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। বন্ড ইস্যু করে সরকার ঋণ নেয়। সরকারি সিকিউরিটিজের বিপরীতে অর্জিত সুদ বা ডিস্কাউন্ট আয়ের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করতে হয়।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঋণপত্রে উৎসে কর কমছে

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে উৎসে করের কোন প্রভাব নেই বললেই চলে। তবুও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী এই উৎসে করের অজুহাতে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। আগামী বাজেটে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে স্থানীয় ঋণপত্রের কমিশনের উৎসে কর কমিয়ে অর্ধেক করা হচ্ছে। বর্তমানে ১ শতাংশ উৎসে কর রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে রয়েছে-ধান, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মটরশুঁটি, ছোলা, মসুর ডাল, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, ডাল, ভুট্টা, মোটা আটা, আটা, লবণ, চিনি, ভোজ্যতেল, কালো গোলমরিচ, দারুচিনি, বাদাম, লবঙ্গ, খেজুর, ক্যাসিয়া পাতা, কম্পিউটার ও কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ ও সব ধরনের ফল।

মামলা নিষ্পত্তি সর্বোচ্চ সুদ দুই বছর

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সুদের সীমা নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সুদের সীমা সীমিত করা হতে পারে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর-সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি মামলায় সুদের চাপও ব্যবসায়ীদের জন্য বড় আর্থিক বোঝা হয়ে ওঠে। দীর্ঘদিন ধরে চলা কর মামলায় পুরো সময়ের (১০ বছরও চলতে পারে) জন্য সুদ আরোপের পরিবর্তে সেটি সর্বোচ্চ দুই বছরে সীমিত করা হবে। এটি ব্যবসায়ীদের জন্য বড় স্বস্তি, কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সুদের অঙ্ক এত বেশি হয়ে যায় যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বকেয়া পরিশোধে স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করতে হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মাঠ পর্যায়ের কর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কর মামলার সুদ সর্বোচ্চ দুই বছর পর্যন্ত সীমিত রাখার ফলে কিছু ব্যবসা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মামলা দীর্ঘায়িত করে কর পরিশোধ বিলম্বিত করতে পারে। ব্যবসায়ীরা সরকারকে রাজস্ব না দিয়ে সেই অর্থ ব্যবসা বা ব্যাংকে বিনিয়োগ করতে পারেন। পরে আদালতে হেরে গেলেও, তারা দুই বছরের সুদ পরিশোধ করেই দায়মুক্তি পাবে। এতে সরকার সময়মতো প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে। এই সুদের বিধান চালু হয়েছিল কর ফাঁকি দিয়ে কর পরিশোধে বিলম্ব রোধের জন্য। এখন এমন একটি কার্যকর ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা আসল ফাঁকিবাজদের চিহ্নিত করে তাদের যথাযথভাবে শাস্তির আওতায় আনবে।

বাজেটে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আরো যেসব পদক্ষেপ থাকছে

আসন্ন বাজেটে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে আরো বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকতে পারে। ব্যবসায়ীরা এতে স্বস্তি পাবেন বলে মনে করেন এনবিআর কর্মকর্তারা। যার মধ্যে রয়েছে-আমদানি ঘোষণাপত্রে ছোটখাটো ভুলের জন্য জরিমানা কমানো এবং আমদানি নীতি আদেশ (আইপিও) লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম জরিমানার নিয়ম শিথিল করা হতে পারে। আমদানির প্রাথমিক বিবরণীর তালিকা (আইজিএম)-এ যেকোনো ভুলের জন্য অন্তত ৫০ শতাংশ জরিমানা দিতে হয়। বাজেটে এই নিয়ম বাতিল করা হতে পারে। ফলে কমিশনাররা ছোটখাটো ভুলের ক্ষেত্রে নামমাত্র জরিমানা নির্ধারণের সুযোগ পাবেন। একইভাবে, আমদানি নীতি আদেশ (আইপিও) লঙ্ঘনের জন্য আমদানি করের সমপরিমাণ ন্যূনতম জরিমানার বিধানও বাতিল হতে পারে। যাতে কমিশনাররা নিজের বিবেচনায় তুলনামূলক কম জরিমানা আরোপ করতে পারেন। এছাড়া জাহাজ কোম্পানিগুলোর কার্গো ঘোষণায় ভুলের জন্য বর্তমানে প্রযোজ্য ন্যূনতম ৫০ হাজার টাকার জরিমানা বাতিল করা হতে পারে। এতে কমিশনারদের সামান্য জরিমানা আরোপের সুযোগ দেওয়া হতে পারে।

প্রায় ১৫০ আমদানি পণ্যে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বসছে

দেশে হাজার হাজার ব্যবসায়ী বিশেষ করে আমদানিকারক রয়েছেন-যারা শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করেন। আমদানি করা পণ্য ন্যূনতম ট্রেড মার্জিনে এসব ব্যবসায়ী বাজারে পণ্য সরবরাহ করেন। তবে ট্রেড মার্জিন ন্যূনতম হলেও কোটি কোটি টাকার ব্যবসার বলে তাদের লোকসানের সম্ভাবনা খুবই কম। এসব ব্যবসায়ীর বেশিরভাগই আয়কর রিটার্ন দেন না। তাদের করজালে আনতে আমদানি করা প্রায় দেড় শতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর অগ্রিম কর বা এআইটি বসানো হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে এসব ব্যবসায়ী ২ শতাংশ হারে এআইটি দেবেন। আয়কর রিটার্ন দেওয়ার পর এই কর সমন্বয় করে নিতে পারবেন। শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করেন, অথচ রিটার্ন দেন না। তাদের কমপ্লায়েন্সের আওতায় আনতে এআইটি বসানো হচ্ছে। তবে এআইটির কারণে বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে না। কারণ এই কর ব্যবসায়ীর চূড়ান্ত করদায় নয়। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা এই কর সমন্বয় করতে পারেন না বা ফেরত পান না। যেসব আমদানি পণ্যে এআইটি বসতে পারে-আলু, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি, ময়দা, ছোলা, ভুট্টা, তুলা ও মানবসৃষ্ট তন্তু। চিকিৎসা সরঞ্জামের মধ্যে হুইলচেয়ার, এনজিওগ্রাফি ও গাইড ক্যাথেটার, কৃত্রিম দাঁত, হিয়ারিং এইড এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্কিং ডিভাইস, কম্পিউটারের মনিটর, প্রিন্টারের রিবন, রাউটার, মডেম, টোনার, অপারেটিং সিস্টেম। এ ছাড়া শিল্প খাতে ব্যবহৃত রাসায়নিক, বিমান, বাস, মাছ ও মাংস।

আয়করের ক্ষেত্রে আরো যেসব পরিবর্তন আসতে পারে

আগামী বাজেটে যেসব করদাতা প্রথম রিটার্ন জমা দেবেন-এমন করদাতাদের জন্য সুখবর থাকছে। নতুন করদাতাদের আয়ভেদে সর্বনিম্ন এক হাজার টাকা আয়কর দেওয়ার বিধান যুক্ত হচ্ছে আয়কর আইনে। মূলত নতুন করদাতাদের করভার লাঘব এবং করভীতি দূর করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেসব করদাতা প্রথমবার রিটার্ন জমা দেবে, কেবল তারা এক হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকার মধ্যে যে কোনো অঙ্কের কর দিতে পারবে। এছাড়া করহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণত মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় এটি। আসছে বাজেটে স্ল্যাব পরিবর্তন ও করহার বাড়ানোয় মধ্যবিত্তের ওপর করের বোঝা বাড়বে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!