কাস্টমসের হয়রানির মাত্রা কমানো দরকার বলে নতুন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানকে জানিয়েছেন দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) নেতারা। ব্যবসায়ীরা বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসসহ সব কাস্টম হাউস, শুল্ক ষ্টেশনে শিল্পের কাঁচামাল, উপকরণ, মুলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ এবং তৈরি পণ্য শুল্কায়ন করার ক্ষেত্রে পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য, এইচএস কোড এবং পণ্যের বর্ণনা নিয়ে জটিলতা তৈরি করার কারণে হয়রানি অনেক বেড়ে গেছে। এই হয়রানির মাত্রা কমানো দরকার। একই সঙ্গে আয়করে নিরীক্ষার নামে করদাতাদের হয়রানি বন্ধ করাসহ অসৎ কর্মকর্তাদের নিয়মনীতির আওতায় নিয়ে আসার অনুরোধ জানানো হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিকভাবে হয়রানি করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে এনবিআরে একটি হটলাইন নম্বর, অ্যাপ বা অভিযোগ কেন্দ্র চালুর প্রস্তাব দেন ব্যবসায়ীরা।
রোববার (২৫ আগস্ট) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে এফবিসিসিআই নেতারা এসব দাবি জানান। এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলমের নেতৃত্বে ফেডারেশনের সাবেক ও বর্তমান নেতারা এনবিআর চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি মো. মুনির হোসেন, পরিচালক মোহাম্মদ ফয়জুর রহমান ভূঁইয়া, এম এ রাজ্জাক খান, তপন কুমার মজুমদার, আবু মুরশেদ চৌধুরী, আবুল কাসেম খান, প্রীতি চক্রবর্তী, মো. আমির হোসেন নূরানী, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন প্রমুখ।
রাজস্ব ব্যবস্থাপনা সংস্কার ও উন্নয়নে নবনিযুক্ত এনবিআর চেয়ারম্যানের নেয়া পদক্ষেপসমূহ এফবিসিসিআই সমর্থন করবে জানিয়ে সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক আইন সংশোধন, পরিমার্জন, পরিবর্তন করার জন্য তিনটি টাস্ক ফোর্স গঠনের পরিকল্পনার কথা আপনি বলেছেন-আমরা তার সাথে একমত। অতীতের ন্যায় গঠিত যৌথ টাস্কফোর্সের সাথে এফবিসিসিআই কাজ করতে আগ্রহী। এই কারণে এফবিসিসিআইসহ সকল স্টেকহোল্ডার যেন গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য হিসেবে থাকতে পারে সেদিকে বিশেষ নজর দিবেন। টাস্কফোর্সকে অর্থবহ ও কার্যকর করতে সঠিক কার্য-পরিধি প্রণয়ন করতে হবে। যেই উদ্দেশ্য গঠন করা হবে-সেটি যেন সফল হয়। এনবিআর-এফবিসিসিআই পার্টনারশীপ পদ্ধতি জোরদার করার কোন বিকল্প নেই। এনবিআরের ব্যাপক সংস্কার দরকার, বিশেষ করে পলিসি এবং পলিসি বাস্তবায়ন পৃথক করা জরুরি। বাজেট অনুবিভাগ নামে একটি পৃথক অনুবিভাগ রাখা, কাস্টমস, মুসক ও আয়করের অটোমেশন এবং এনএসডব্লিউ দ্রুত বাস্তবায়নের অনুরোধ জানান সভাপতি।
সভাপতি বলেন, ইতোমধ্যে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর বিষয়ে আপনি উদ্যোগ নিবেন বলে জানিয়েছেন। যার সাথে আমরা একমত। সক্ষম করদাতাদেরকে আয়করের আওতায় আনতে হবে। কর্মকর্তাদেরকে সেই কাজ করতে হবে। আমরা কেন পিছিয়ে থাকব। অর্থনীতির আকার এবং বাজেটের আকার ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ে। কিন্তু সেই তুলনায় করদাতার সংখ্যা বাড়ে না। এফবিসিসিআই মনে করে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার পাশাপাশি প্রতিটি কর অঞ্চলে করদাতাদের সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাহলে অবশ্যই আমরা কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে পারব। প্রতিটি উপজেলায় করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য যৌথভাবে কাজ করতে হবে। জেলা চেম্বারগুলিকে সাথে নিয়ে মাঠ পর্যায়ের অফিসকে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিতে পারেন।
চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আয়কর অডিটে পরিবর্তন দরকার। যতটুকু জেনেছি, অডিট ম্যানুয়াল প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু সেটি গেজেট হয়নি। আমরা মনে করি, এই কাজটি আপনি করে দিবেন। যাতে করদাতারা অডিটের নামে হয়রানি এবং অত্যাচার থেকে রেহাই পায়। সৎ করদাতা এবং অসৎ করদাতা-এই ধরনের বৈষম্য থাকতে পারে না। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত টাকা বিনিয়োগ সুযোগ যেন আগামীতে কখনোই দেয়া না হয়। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনে এই বিধান থাকা কখনোই কাম্য নয়। এনবিআর ভবনে এফবিসিসিআই-এর জন্য একটি স্পেস বরাদ্দের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে-যা সকল বাণিজ্য সংগঠনের সাথে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে। বাজেট কাজ, আইন কানুন, প্রজ্ঞাপন (এসআরও), ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ, সাধারণ আদেশসহ সকল ধরনের পরিবর্তন অতি দ্রুত সকলের মধ্যে শেয়ার করা যেতে পারে। এ উদ্যোগ এনবিআর ও এফবিসিসিআইয়ের মধ্যকার পার্টনারশীপকে আরো জোরদার করবে।
কর্মকর্তাদের বিষয়ে সভাপতি বলেন, কর্মকর্তাদেরকে অবশ্যই নিয়ম নীতি মেনে চলতে হবে। আইনের অপপ্রয়োগ করার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা কম দায়ি না। করফাঁকি উদ্ঘাটন করলেই পুরস্কার বা প্রণোদনা অনেক সময় আইনের অপ্রয়োগ হয়-যা বন্ধ হওয়া দরকার। এই জন্য এই ধরনের বিধান বাতিল করতে হবে। বিকল্প উপায়ে তাদেরকে প্রণোদনা এবং স্বীকৃতি দেয়া যেতে পারে। এডিআর কার্যকর করা। আয়কর, শুল্ক এবং মূসক এডিআর কার্যকর করতে সহায়তাকারীদেরসহ একটি আলোচনা সভা করার দরকার। যারা কষ্ট ও পরিশ্রম করে বিরোধ নিষ্পত্তি করে দেয় অথচ সেই সহায়তাকারীরা তাদের সম্মানীর অর্থ পর্যন্ত পাচ্ছেন না। এটা আপনাকে দেখতে হবে।
তিনি বলেন, কাস্টমস আইন, ২০২৩; আয়কর আইন, ২০২৩ এবং মূল্য সংযোজন ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ২০১২ আমাদের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। যেগুলি ব্যবসা-বাণিজ্য ও ন্যায় বিচার এবং বৈষম্য দূরীকরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় পর্যালোচনা করা দরকার। এই জন্য যৌথ টাস্কফোর্স করে দিলে আমরা কাজ করতে পারি। ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক পরিবেশ উন্নয়ন এবং রাজস্ব আহরণের স্বার্থে সেগুলি বিবেচনায় নিতে হবে। এফবিসিসিআই কখনও দুর্নীতি পরায়ন এবং অসৎ ব্যবসায়ীদের সমর্থন করে না। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে চলমান অভিযানের সফলতা কামনা করি। তবে এনবিআরের শুল্ক, মূসক এবং আয়করের অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরকে চিহ্নিত করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাদের কারণেই আইন কানুনের অপপ্রয়োগ হতে হয়। এনবিআরের গোয়েন্দা ইউনিটকে কাজে লাগানোর এখনই উপযুক্ত সময়।
এ সময় ঢালাওভাবে দোষারোপ না করে অসৎ কর্মকর্তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তিনি ব্যবসায়ীদেরও সততার সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার আহ্বান জানান। চেয়ারম্যান বলেন, কর নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আর মানুষ জড়িত থাকবে না। শিগগির এখানে অটোমেশন চলে আসবে। আমাদের টিমকে সেই অনুযায়ী নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তারা অচিরেই কাজ শুরু করবে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে ধাপে ধাপে অটোমেশনের আওতায় আনা হবে।
***